মহামারির মধ্যে খাদ্যসহায়তা কাজ ও আয় হারানো মানুষের জন্য যে খুবই দরকারি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বিষয়টিকে আরও বিস্তৃতভাবেও দেখা যায়। কারণ, খাদ্যসহায়তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও গতি সঞ্চার করে। বিশ্লেষকেরাই বলেন, খাদ্য ও পুষ্টিসহায়তা কর্মসূচিতে ১ ডলার ব্যয় করলে অর্থনীতিতে ১ দশমিক ৬৭ ডলারের সুফল পাওয়া যায়।
সারা বিশ্বে এখন করোনাভাইরাসের ডেলটা ভেরিয়েন্টের দাপট চলছে। যে যুক্তরাষ্ট্র সংক্রমণ বেশ কমিয়ে এনেছিল, সেখানেও এখন নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। এতে আগস্ট মাসের শুরুতে দেশটিতে ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর আগে গত বছরের এপ্রিল মাসে সারা বিশ্ব যখন বিধিনিষেধ আরোপ ছিল, তখন ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস এর চেয়ে কম ছিল। এ ছাড়া ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময়ে ভোক্তার আত্মবিশ্বাস এখনকার চেয়ে কম ছিল। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।বিজ্ঞাপন
এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিসহায়তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। গত ১৫ বছর এই কর্মসূচিতে বার্ষিক ৭৯ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার করে ব্যয় করা হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এবার এ কর্মসূচিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও গতি আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
মুডিস অ্যানালিটিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জান্ডির মতে, খাদ্য ও পুষ্টিসহায়তা কর্মসূচিতে ১ ডলার ব্যয় করা হলে অর্থনীতিতে ১ দশমিক ৬৭ ডলারের সুফল মিলে। রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ১ ডলার সহায়তা বাবদ অর্থনীতিতে যুক্ত হয় ১ দশমিক ৩১ ডলার। আর ১ ডলার করপোরেট কর হ্রাস করলে তাতে অর্থনীতিতে শূন্য দশমিক ৩২ ডলারের সুফল মেলে। অর্থাৎ খাদ্যসহায়তা বাবদ ব্যয় বাড়ানো হলে অর্থনীতিতে তার সুফল সবচেয়ে বেশি যুক্ত হয়। বিষয়টি হচ্ছে, যাঁরা এই খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন, তাঁরা মূলত পে–চেকের ওপর ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এই সহায়তা পেলে তাঁরা পুষ্টিকর খাবারে ব্যয় বাড়াতে পারেন। ফলে তাঁদের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা আসে। ভোক্তা ব্যয় বাড়ে।
সিএনবিসির এক সংবাদে বলা হয়েছে, খাদ্য ও পুষ্টি কর্মসূচিতে সহায়তার বদৌলতে গড় সুবিধা বাড়বে ২৫ শতাংশ। নিউইয়র্ক টাইমস-এর তথ্যানুসারে, এই কর্মসূচির বরাদ্দ এ বছর বাড়বে ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এই সহায়তা ছোট মুদিদোকানিদের থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতাদের জীবন সহজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একদিকে মহামারি, অন্যদিকে বড় বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও ক্রমবর্ধমান মজুরি, এই দুই চাপে ছোট ব্যবসায়ীদের চিড়ে–চ্যাপটা হওয়ার জোগাড়। এখন তাঁরা খাদ্যসহায়তা পেলে অন্যান্য খরচের বেলায় একটু হাত খুলতে পারবেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘এই সহায়তার ফলে মুদি পণ্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরো চক্র লাভবান হবে।Ñতাতে কৃষক থেকে শুরু করে উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতা সবাই লাভবান হবেন। করোনা মহামারির মধ্যে সারা বিশ্বেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উন্নত দেশগুলো বিভিন্নভাবে নগদ ও খাদ্যসহায়তা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলেও উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। গত দেড় বছরে এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় হার ৬ শতাংশের ওপরে। অন্তত ১০টির বেশি এলডিসিভুক্ত দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে।
মানুষের আয় যখন কমে যায় বা খাদ্যের দাম বাড়ে, সেই ধাক্কা মোকাবিলায় মানুষ যা করে তা হলো, খাদ্য ব্যয় কমানো। খাদ্য ব্যয় কমানোর বড় খাত হচ্ছে আমিষ বাবদ ব্যয় কমানো। ফলে পুষ্টিমান হ্রাস পেলে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। ফলে খাদ্য ব্যয় হ্রাসের প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী।
২০২০ সালে অতিমারির সময় থেকে এ পর্যন্ত মাংসের বিক্রিবাট্টা ১২ শতাংশ কমেছে আমেরিকায়। ইউরোপে শুধু বিফ বা গরুর মাংসের চাহিদা গত বছর অনেকটা কমেছিল। এ বছর তা আরও ১ শতাংশ কমবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকেরা। খাদ্য হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাংস গ্রহণ করে আর্জেন্টিনার মানুষ। সেখানেও গত এক বছরে ৪ শতাংশ কমেছে মাংস কেনার প্রবণতা।
আমিষ খাওয়া কমানোর প্রভাবও মারাত্মক। পুষ্টিবিদেরা বলেন, শিশুদের অনেক রোগের সঙ্গে পুষ্টিসম্পর্কিত। বিশ্লেষকেরা বলেন, বিশ্বের বহু দেশে এখনো শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। প্রাণিজ প্রোটিন তাদের দ্রুত সুস্থ করতে সক্ষম। তাই প্রাণিজ প্রোটিন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সঠিক নয়।
অন্যদিকে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোটবেলায় পুষ্টিহীনতায় ভুগলে ভবিষ্যতে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ খাদ্যসহায়তার যেমন তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক প্রভাব আছে, তেমনি সুদূরপ্রসারী প্রভাবও রয়েছে।