চঞ্চল চৌধুরী গত সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার মঞ্চে ‘চের সাইকেল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। কয়েক বছর বিরতির পর এই নাটকে আবারও অভিনয়ে দেখা গেছে চঞ্চল চৌধুরীকে। এদিকে আরণ্যকের ‘রাঢ়াঙ’ নাটকেও অভিনয় করলেন এই অভিনয়শিল্পী। বিরতির পর মঞ্চে ফেরার অনুভূতি, প্রস্তুতি ও নাটকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন তিনি।
দীর্ঘদিন পর মঞ্চে ফিরলেন। অনুভূতি ও প্রস্তুতির কথা বলুন।
মঞ্চের বিষয়টা তো টেকনিক্যাল। অনেক প্রস্তুতি দরকার। টেলিভিশনের কাজ সহজ। কারণ, টানা দুই ঘণ্টা পারফর্ম করতে হয় না। ক্লোজ, লম্বা, মাস্টার শট এবং একই শট বারবার দেওয়ার সুযোগ থাকে। মঞ্চে সেই সুযোগ নেই। মঞ্চে অভিনয় বন্দুকের গুলির মতো। একবার গুলি বের হয়ে গেলে ফেরানো যায় না। তেমনি মঞ্চে ভুল হলে শোধরানোর কোনো সুযোগ নেই।
তার মানে, একটা মানসিক চাপ থাকে?
ওই টেনশন তো
থাকেই। এ কারণে অবশ্যই মহড়া করতে হয়। ‘চের সাইকেল’ অনেক বছর পর করলাম।
মঞ্চে অভিনয় করলে ফিজিক্যাল ফ্লেক্সিবিলিটি দরকার। অনেক দিন মঞ্চে অভিনয় না
করলে শারীরিক কেমিস্ট্রি নষ্ট হয়ে যায়। ওটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হয়। এত বছর
পর ফিরে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা দেখলাম, মঞ্চটা বুকের ভেতরেই আছে। ১৫ বছর আগে
যে প্রোডাকশনে কাজ করেছি, সংলাপগুলো একবার শুনলেই মনে পড়ে যাচ্ছিল। প্রথম
দিন কিছুটা কঠিন হলেও দ্বিতীয় দিন গড়গড় করে সংলাপগুলো বলে ফেলতে পারছিলাম।
আর ‘রাঢ়াঙ’ করার সময় শুরুতে ভয় পাচ্ছিলাম। শো করার সময় মনেই হয়নি, তিন বছর
পর নাটকটি নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েছি। মিউজিক ও পুরো আবহ আমাকে আগের সেই সময়ে
নিয়ে গেছে। এটা একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি। তবে একধরনের উত্তেজনা, ভয়
কিন্তু ঠিকই কাজ করে। রিলাক্স হয়ে গেলে তো আর হয় না। যেকোনো কাজের জন্য
একটু টেনশন দরকার হয়।
মঞ্চে নিয়মিত হওয়ার কথা ভাবছেন কি?
আরণ্যকের
অনুষ্ঠানের জন্য ১৫ দিন কোনো শুটিং করিনি। টেলিভিশন নাটকের ব্যস্ততার জন্য
মঞ্চে আমি ততটা সময় দিতে পারছি না। তবে আমি এদিকে আসবই। মঞ্চই আমার আলটিমেট
লক্ষ্য। ৪-৫ বছর পর হয়তো নিয়মিত মঞ্চেই থাকব। মাঝেমধ্যে টেলিভিশন অথবা
সিনেমায় কাজ করব, যদি সুযোগ পাই। এখন এমন সময় যাচ্ছে, টেলিভিশনের কাজের
কারণে সমন্বয় করতে পারছি না। এই ব্যস্ততা তো সব সময় থাকবে না। এখানে বলে
রাখতে চাই, ‘আয়নাবাজি’ ছবিতে ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছি। আজ থেকে ১৫ বছর আগে
‘চে’র সাইকেল’ নাটকে প্রথম ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। মঞ্চ আমাকে এই
শিক্ষার ভিত গড়ে দিয়েছে। এখন মঞ্চে আসলে দর্শক খুব কম যায়। মঞ্চকে চাঙা
করার চেষ্টা চলছে।
মঞ্চে দর্শক কম। অনেকে বলছেন, মঞ্চে অভিজ্ঞতাহীন টিভি নাটকের অনেক
অভিনয়শিল্পী। তাঁদের অনেককে বলতে শোনা যায়, অভিনয় করতে করতেই শিখছেন তাঁরা।
আপনার কী মত?
আমি মনে করি, যে কাজই করুক না কেন, তার জন্য একটা শিক্ষার
দরকার হয়। অভিনয় যে করবে, তারও তো একটা শিক্ষার দরকার পড়ে। অভিনয় শিখতে
হবে, এ জন্য মঞ্চের কোনো বিকল্প নেই। মঞ্চে না গেলে তো অভিনয় শেখার জায়গাটা
অপূর্ণ থেকে যাবে। হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন, দেখে কিছুটা শেখেন, কিন্তু
সেই শেখাটা পূর্ণাঙ্গ হয় না। দেখে দেখে শিখে লম্বা দৌড়ে টিকতে পারবে বলে
মনে হয় না। অনেক গুণী অভিনয়শিল্পী টিকে থাকতে পারেননি।
দেবী চলচ্চিত্রে চঞ্চল চৌধুরী ও জয়া আহসান। ছবি -সংগৃহীত
গুণী নাকি জনপ্রিয়?
জনপ্রিয়…জনপ্রিয়। অনেক
জনপ্রিয় তারকাকে দেখেছি মধ্যগগনে। ছয় মাস, দুই বছর কিংবা তিন বছর পর তাঁরা
টিকে থাকতে পারেননি। কারণ একটাই, তাঁদের অভিনয়শৈলী একমুখী। বৈচিত্র্য নেই।
মঞ্চ থেকে যদি শিক্ষা নিতে পারতেন, তাহলে অভিনয়ে বৈচিত্র্য আনতে পারতেন। ২৩
বছর মঞ্চে কাজ করছি, বাকি জীবনটাও এখানে কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।
এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে শেখার কোনো শেষও নেই।
টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। একটা নাটকের ৭০ শতাংশ
টাকা নিয়ে যাচ্ছেন প্রধান চরিত্রের দুই অভিনয়শিল্পী। আমাদের পত্রিকায় এ
নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
আমি রিপোর্টটা দেখেছি। ওটা একপেশে বলা।
যাঁরা বলেছেন ৭০ শতাংশ টাকা নিয়ে যাচ্ছে, এটা গুটিকয়েক শিল্পীর ক্ষেত্রে,
সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গুটিকয়েক পরিচালক দিচ্ছেন আর গুটিকয়েক তারকা
নিচ্ছেন। আমি বলতে চাই, গুটিকয়েক পরিচালক দিচ্ছেন যে তাঁদের কি মেরুদণ্ড
নেই? কারণ, একটা নাটকের ৭০ শতাংশ টাকা যদি দুজন অভিনয়শিল্পীকে দিয়ে দেওয়া
হয়, তাহলে বাকি ৩০ শতাংশ টাকায় কীভাবে তিনি নাটক বানান? আর তিনিই–বা কোন
মানের পরিচালক, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমনও হতে পারে, অনেক চাপে পড়ে দিতে
হচ্ছে। কিন্তু তিনি কেন প্রতিবাদ করছেন না?
একজন তারকার চাহিদা থাকলে তিনি তো বেশি সম্মানী নিতে পারেন, নাকি?
এটা
শিল্পীদের বিবেকের প্রশ্ন। তাঁরা যে জায়গায় আছে, সেই জায়গার সামর্থ্য
কতটুকু, সেটাও ভাবতে হবে। আমার বাবা যদি গরিব হন, আমি কি সেই বাড়িতে প্রতি
বেলা পোলাও-কোরমা খেতে চাইব? মানলাম, তারকারা অনেক জনপ্রিয়। তাঁদের সম্মানী
অনেক পাওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের বাজারটার কথাও তো ভাবতে হবে। সবকিছুর দাম
বেড়েছে, কমেছে শুধু নাটকের বাজেট।
নাটকের বাজেট বেশি হলে কি নিতে পারত?
বাজেট বেশি
থাকলে সমস্যা ছিল না। আমরা নাটকের সেই বাজারটাও তো তৈরি করতে পারিনি; বরং
দিন দিন নষ্ট করেছি। নাটকের মান খারাপ হলে কিন্তু দায় শিল্পীদের ওপরেও
আসবে। হাতে গোনা দু–চারজন স্বার্থপর শিল্পীর চিত্র, যাঁরা নাটকের
ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করেন না, টাকার কথা চিন্তা করে তারাই এই কাজটি
করে। ওই দলে শিল্পী বেশি নেই।
বাবা চঞ্চল চৌধুরীর তোলা সেলফিতে ছেলে। ছবি-সংগৃহীত
আনুষঙ্গিক খরচ যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, শিল্পীদের সম্মানীও তো বাড়বে।
বাড়বে।
সেটা আমি একা বাড়াতে পারি না তো। আমি জানি, আমার সম্মানী কত নেওয়া উচিত,
কিন্তু আমার ইন্ডাস্ট্রি তো সেই টাকা দিতে পারবে না, এটাও বুঝতে হবে।
চাহিদা আছে বলেই এমনটা করা হচ্ছে নাকি?
এ রকম বহু
চাহিদাসম্পন্ন শিল্পী আছেন। শুধু ইন্ডাস্ট্রির কথা ভেবে, নাটকের মানের কথা
ভেবে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। আমার দাম আমি বাড়ানোর কে? আমাকে সম্মান দেবে
অন্য মানুষ। আমি যদি সব সময় নিজের সম্মান বাড়ানোর চিন্তায় থাকি, তাহলে
কেমনে কী!
টেলিভিশন নাটকের সবচেয়ে বড় সংকট কী?
বড় সংকট হচ্ছে,
মানসম্পন্ন কাজের অভাব। আজেবাজে লোকের প্রবেশ। টেলিভিশন নাটক যাঁদের
নিয়ন্ত্রণে আছে, তাঁদের ক্ষমতা আছে ঠিকই, কিন্তু যোগ্যতা নেই।
আজেবাজে লোক কোথায় কোথায়?
অনেক জায়গায়। অভিনয়,
পরিচালনা, প্রযোজনা—সব জায়গাতেই আজেবাজে লোক ঢুকে পড়েছে। টেলিভিশন নাটক
একধরনের বাজে সিন্ডিকেটে চলছে। আমার যোগ্যতা নেই অভিনয়ের, কিন্তু বড়
পরিচালকের সঙ্গে লিয়াজোঁ আছে। পরিচালকের ভালো নাটক বানানোর ক্ষমতা নেই,
কিন্তু প্রযোজক পর্যায়ে কিংবা এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশ আছে। আবার এজেন্সির
ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিল্প কী সেটা বোঝে না, অথচ চ্যানেলের সঙ্গে লিয়াজোঁ
করে পার করে দিচ্ছে। চক্রাকার পদ্ধতিতে মানহীন কাজ চলছে। এটাই এখন
ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় সমস্যা। আরেকটা বিষয়, ভালো কনটেন্ট, ভালো গল্পের
খুব অভাব। যে হারে কাজ হচ্ছে, সে হারে ভালো গল্প নেই, স্ক্রিপ্ট নেই। দর্শক
ধরে রাখার মতো গল্প নেই।
‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রে চঞ্চল চৌধুরী। ছবি-সংগৃহীত
দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতায় কোনো আশার আলো কি দেখছেন না?
একসময়
খুব দেখতাম। তখন খুব অল্প বুঝতাম, অভিজ্ঞতাও কম ছিল। সামনে শুধু আলো
দেখতাম। এখন আলো খুব বেশি একটা দেখি না, সামনে অন্ধকারের পরিমাণটা বেশি।
তারপরও মনে হয়, কেউ না কেউ আলো জ্বালবে, এই আশাটুকু রাখি। তবে সব মিলিয়ে
আমি অনেকটাই হতাশ।
কেন এত হতাশ?
আমরা যখন কাজ শুরু করছিলাম, সাত বছর
আগেও নাটকের ইন্ডাস্ট্রির যে অবস্থা ছিল, দিন দিন সেটা খারাপের দিকে গেছে।
ইন্ডাস্ট্রি বড় যত হয়েছে, ততই খারাপের দিকে গেছে। আমাদের কাজটা ক্রিয়েটিভ।
একটা সময় এখানে অনেক বেশি সৃজনশীল মানুষের পদচারণ ছিল। এখন সৃজনশীলেরাই
কোণঠাসা। নন-ক্রিয়েটিভ লোকদের ক্ষমতার দাপটে ক্রিয়েটিভ লোক জিম্মি। সবাই
যায় উন্নতির দিকে, আমরা যাচ্ছি অবনতির দিকে, খারাপের দিকে। সেটা অন্য কেউ
নিয়ে যাচ্ছে না, আমরাই করছি। যে যেই সেক্টরে আছেন, তাঁরা এসবের জন্য দায়ী।
আপনাকেও তো হালকা গল্পের নাটকে অভিনয় করতে দেখা যায়। এটাও তো অনেকের অভিযোগ।
একটা
মানুষের সব কাজ তো আর শতভাগ ঠিক হয় না। মান্না দে একজীবনে হাজার হাজার গান
গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া সব গান কি একই মানের? একজন শিল্পীর ক্ষেত্রেও সব নাটক
আর সিনেমা একই মানের করা সম্ভব নয়। এসব কাজ সমন্বিত টিমওয়ার্কের ফসল। একটা
কাজ শেষ না করা পর্যন্ত বোঝাও যায় না, সেটা আদৌ কতটা ভালো হবে। শুটিংয়ের
আগে দেখা গেল, গল্প ভালো ছিল, শুটিংয়ে গিয়ে দেখলাম সহশিল্পী ভালো নয়। আবার
দেখা যায় চিত্রনাট্যে গল্পটা যেভাবে বলা হয়েছে, পরিচালক সেভাবে পর্দায় বলতে
পারেননি। একজন মানুষের জীবনে সব কাজ একই মানের হবে, সেটা ভাবা উচিত নয়।
এ ক্ষেত্রে অর্থ উপার্জনের বিষয়টা কি বেশি কাজ করে?
এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমার পেশা হচ্ছে অভিনয়। অন্য কোনো কাজ তো আমি করি না। তার মানে, আমার সন্তানের মুখে যদি খাবার তুলে দিতে চাই, আমার ঘরের খাবার, পোশাক পরিচ্ছদের কথা ভাবতে হয়, আমাকে তো কিছু একটা করতে হয়। আমি কী করব? তবে এটাও ঠিক যে আমার হয়তো ওই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মাসে ১০ দিন শুটিং করলেও আমার সংসার চলে। সংসার চালাতে আমার বেশি টাকা লাগে না। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু হলেই চলে। আমি বাহাদুরি করি না। কোটি টাকা ব্যাংকে জমা থাকতে হবে, তা ভাবি না। অভিনয় ছাড়া আমার অন্য কোনো পেশা নেই। ধান্দাবাজিও নেই। এখনকার অভিনয়শিল্পীদের অনেকেরই অভিনয়ের পাশাপাশি নানা ধরনের ব্যবসা থাকে। অনেক কিছু করেন। টাকার লোভ তাঁদের অনেক বেশি। আজ যদি অভিনয় না করে আমি চাকরি করতাম, কত টাকা আয় করতাম? একটা নাটকের ৭০ শতাংশ টাকা যাঁরা নিয়ে যান, পত্রিকায় খবরও হয়, তাঁরা চাকরি করলে কত টাকা পেতেন, সেটাও ভাবা উচিত। মোটকথা, আমি যদি আমার ইন্ডাস্ট্রির দিকে না তাকাই, আমার ইন্ডাস্ট্রিও মুখ ফিরিয়ে নেবে। এসবের সুদূরপ্রসারী ফল ভালো নয়। একসময় আকাশের তারা কোথায় চলে যায়, কেউ জানে না।
সূত্র: প্রথম আলো