নতুন সড়ক আইনের যেসব কঠোর ধারা সংশোধনের দাবি ছিল মালিক-শ্রমিকদের, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। যেসব ধারার কারণে মালিক-শ্রমিকেরা বড় ধরনের আর্থিক জরিমানায় পড়তে পারেন, সেগুলোর প্রয়োগ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার গভীর রাতে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিকেরা সারা দেশে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক নেতাদের বৈঠক হয়। ওই বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নতুন সড়ক আইনের ৯টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। চালকদের লাইসেন্স-সংক্রান্ত ও যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তন-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি জুন পর্যন্ত নতুন আইনে হবে না বলে ঘোষণা দেন তিনি। এ ছাড়া আইন সংশোধন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সুপারিশ আকারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
বৈঠকে পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব এবং শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি সাদিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এই সংগঠনের ডাকে বুধবার ভোর থেকে সারা দেশে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ধর্মঘট পালন করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ট্রাফিক পক্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়ন করার সময় কয়েকটি যৌক্তিক জটিলতা দেখা যায়। আমরা প্রস্তাব আকারে ৯ দফা দাবি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এ বিষয়ে যৌক্তিক ব্যবস্থা নেবেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইনটি বাস্তবায়নের মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আমরা আইনটি পরিবর্তন করব।’
কঠোর ধারা সংশোধনের দাবি বিবেচনায় নিয়েছে সরকার।
কঠোর শাস্তি আপাতত প্রয়োগ নয়।
এ মাসে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পর গত শনিবার থেকে সারা দেশের পরিবহনশ্রমিকেরা জেলায় জেলায় ধর্মঘট শুরু করেন। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যাত্রী পরিবহন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে সারা দেশের শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দুই দিনব্যাপী বর্ধিত সভা গতকাল সেগুনবাগিচায় শুরু হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। আজ বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানাবে তারা। তবে গতকাল পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন আইনের সংশোধনী চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এর প্রতি আস্থা রেখে যানবাহন চলাচল সচল রাখার আহ্বান জানানো হয়।
সড়ক পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের নেতারা ৯টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন। শ্রমিক ফেডারেশনের দাবিও মোটামুটি একই। তারাও কিছু দাবি এদিক-ওদিক করে সরকারের কাছে জমা দেবে। তবে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায় করে নেওয়ায় ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাঠের নেতারা।
এক বছরের বেশি সময় পর ১ নভেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করে সরকার। কিন্তু সচেতনতার কথা বলে সরকার আইনের প্রয়োগ দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়। গত সোমবার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে নতুন সড়ক আইন আংশিকভাবে প্রয়োগ শুরু করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। নতুন আইনে ৪১টি ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও ৫ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ২ বছর। বাকি ৭টি ধারায় সাজা ৩ বছর বা এরও বেশি। এই ৭টি ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, ২ বছরের কম কারাদণ্ড রয়েছে এমন ধারাই প্রয়োগ করতে পারবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘট কর্মসূচির কারণে শিথিলতা দেখান আদালত। সোমবার বিভিন্ন অপরাধে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। গতকাল জরিমানা আদায়ের পরিমাণ সাড়ে ৩৫ হাজার টাকা।
পুলিশ এখনো নতুন সড়ক আইনে মামলা দেওয়া শুরু করেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মালিক-শ্রমিকদের বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে পুলিশ যদি কঠোর শাস্তির ধারাগুলো প্রয়োগ না করে, তাহলে আইনটির প্রয়োগ কার্যত শিথিল হয়ে পড়বে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, সরকারের এই অবস্থানের ফলে নতুন সড়ক আইনের কঠোর শাস্তির বেশির ভাগ ধারাই আর এখন প্রয়োগ হবে না। বিশেষ করে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ বাণিজ্যিক যানবাহনের মালিক-শ্রমিকেরা নতুন আইনের খুব একটা আঁচ পাবেন না।
মালিক-শ্রমিকদের যত দাবি
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে
বৈঠকে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নতুন সড়ক আইনের ৯টি
ধারা পরিবর্তন চেয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯৮ ও ১০৫।
এর মধ্যে ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা সবচেয়ে কঠোর এবং এর অপরাধে মামলা অজামিনযোগ্য।
এর বাইরে চালকের লাইসেন্স-সংক্রান্ত ৬৬ ধারা এখনই প্রয়োগ না করার দাবি
করেছে।
সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, ৮৪ ধারায় মোটরযানের কারিগরি পরিবর্তনের বিষয়টি রয়েছে। ৯৮ ও ১০৫ ধারায় সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি ধারা সংশোধন করে অপরাধ জামিনযোগ্য করার দাবি জানিয়েছেন মালিক-শ্রমিকেরা। এ ছাড়া এসব ধারায় থাকা তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও কমানোর দাবি করেছেন। বাকি ছয়টি ধারায় জরিমানার পরিমাণ কমানোর দাবি করেছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।
আইন অনুসারে, ৭৪ ধারায় মোটরযানের ফিটনেস সনদ থাকার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। এই ধারা অমান্যের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৭৬ ধারায় ট্যাক্স-টোকেন হালনাগাদ না থাকলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ৭৭ ধারায়, রুট পারমিট ছাড়া যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা। ৮৬ ধারায় অতিরিক্ত মাল বহনের নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকার জরিমানা। ৯০ ধারা অনুসারে, নির্ধারিত স্থানের বাইরে যানবাহন পার্ক করা যাবে না। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা।
সরকার কোন দাবি মানল
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান
মালিক-শ্রমিকেরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, পরিবহনচালকদের ৮০
শতাংশই হালকা ও মাঝারি যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালাচ্ছেন। এই অপরাধে
নতুন আইনের ৬৬ ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা
অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বৈঠকে এই ধারা প্রয়োগ না করার দাবি করেন
মালিক-শ্রমিকেরা। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন,
মালিক-শ্রমিকদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত
লাইসেন্স-সংক্রান্ত ৬৬ ধারায় মামলা হবে না। অর্থাৎ এখন যার যে লাইসেন্স
আছে, তা দিয়েই ভারী যানবাহন চালাতে পারবেন। এ সময়ের মধ্যে বিআরটিএর সঙ্গে
আলোচনা করে দ্রুত লাইসেন্স হালনাগাদ করে নেওয়ার পরামর্শ দেন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়া ৮৪ ধারার অপরাধেও আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নতুন
আইনে শাস্তি হবে না বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ধারাসহ ৯টি ধারা সংশোধনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে তিনি তাঁর সুপারিশ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে আইনের এই ধারাটির প্রয়োগ হবে কি না, সেটি পরিষ্কার করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
নতুন সড়ক আইনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে প্রস্তাব দিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। তাঁরা মালিক-শ্রমিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে আইনের কিছু কিছু বিষয় সংশোধনের প্রস্তাব তৈরি করে তা সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর কাছে দেন। এরই মধ্যে ১ নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক আইন কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, আইনের প্রয়োগ করতে যাওয়া, এরপর মালিক–শ্রমিকদের আন্দোলন, সরকারের সঙ্গে বৈঠক, আইন প্রয়োগে শিথিলতা—এসব বিষয় পরিবহন খাতে নতুন নয়। এবার পুনরাবৃত্তি হলো। আসলে পরিবহন খাত বিশৃঙ্খলায় ভরা, অনেক কিছুই আছে, যা পুরোপুরি অবৈধ। কিন্তু অর্থনীতিতে এমনভাবে মিশে গেছে যে, তা বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। এখন পুরো পরিবহন ব্যবস্থায় একটা বড় অস্ত্রোপচার দরকার। অন্যথায় আইন ভোঁতা বা ধারালো, পরিপক্ব বা অপরিপক্ব—কোনোটাই প্রয়োগ করা যাবে না।