রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা এখনই তাদের আদি নিবাসে ফিরতে চাইছে না। এই সুযোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতাকারীরাও মাঠে সক্রিয়। অবশ্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর সব প্রস্তুতি আছে। তবে রোহিঙ্গারা যেতে না চাইলে বাংলাদেশ কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না। এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক হয়েছিল। রোহিঙ্গারা রাজি না হওয়ায় সেবার একজনকেও রাখাইনে পাঠানো যায়নি। আজ কেউ রাখাইনে যেতে না চাইলে এ নিয়ে দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ব্যর্থ হবে।

অবশ্য গতবারের তুলনায় এবারকার আবহে কিছুটা গুণগত পরিবর্তন রয়েছে। গতবার সাক্ষাৎকারের জন্য রোহিঙ্গাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি দেশি–বিদেশি প্রত্যাবাসনবিরোধী পক্ষগুলো বেশ সক্রিয় ছিল। এবার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী সচেষ্ট থাকায় মঙ্গলবার ২১টি এবং গতকাল ২১৪টি পরিবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গেছে। এর পাশাপাশি এবারই প্রথম ঢাকায় চীনা দূতাবাসের দুই কূটনীতিক ও মিয়ানমার দূতাবাসের এক কূটনীতিক সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারে রয়েছেন। তবে এত কিছুর পরও আজ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জোর অনিশ্চয়তা আছে। কারণ, ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসির দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া লোকজন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁরা এখন রাখাইনে যেতে রাজি নন। 

প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না—জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম গত রাতে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আমরা পুরোপুরি তৈরি আছি। চীন ও মিয়ানমার দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে যাব। কেউ রাখাইনে যেতে চাইলে তাঁদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য তিনটি শিবিরের কাছে অন্তত পাঁচটি বাস ও একটি ট্রাক তৈরি থাকবে।’

বাংলাদেশের প্রস্তুতি আছে, অথচ রোহিঙ্গাদের কেউ তো ফিরতে আগ্রহী নয়—এ প্রশ্নের উত্তর আবুল কালাম সরাসরি দেননি। শুধু বলেছেন, যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের তথ্য সন্নিবেশ করা হচ্ছে। 

তবে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ঠিক করা সময় অনুযায়ী আজ আদৌ প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না, সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নন। 

এ নিয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা আশাবাদী। প্রস্তুতিও আছে। কাল (আজ) কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় দেখা যাক।’

বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি যেদিকেই যাক, রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া অব্যাহত থাকবে। এই দফায় যে ১ হাজার ৩৩ পরিবারের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া চলতে থাকবে। কেউ যাওয়ার আগ্রহ দেখালে তা মিয়ানমারকে জানিয়ে, প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁদের মতে, এবার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো থাকায় প্রথম দিনের তুলনায় অনেক বেশিসংখ্যক পরিবার সাক্ষাৎকার দিতে এসেছে।

২৩৫ পরিবারের সাক্ষাৎকার

টেকনাফের জাদিমোরা শালবাগান শিবিরে অবস্থিত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) সহকারী খালেদ হোসেনের কার্যালয়ে অন্তত ২১৪টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর আগে ১০টি আলাদা দল শিবিরের বিভিন্ন ব্লকে গিয়ে সাক্ষাৎকারের জন্য রোহিঙ্গাদের কেন্দ্রে যেতে প্রচারণা চালায়। ১০ জনের দলে রয়েছেন ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসির প্রতিনিধি, রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী, রোহিঙ্গা মাঝিসহ অনেকে।

সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য ১ হাজার ৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৫৪০ জনের নামের তালিকা পাঠায়। এর মধ্যে জাদিমোরার শালবাগান শিবিরে রয়েছে ৯৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৯১ জন। কিন্তু সাক্ষাৎকারের জন্য তালিকাভুক্ত অধিকাংশ রোহিঙ্গাকেই শিবিরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

গতকাল সাক্ষাৎকার দেন জাফর আলম (৪২)। তিনি বলেন, তিনি মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি কি না, জিজ্ঞেস করেন ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তা। তিনি জানিয়ে দেন, পাঁচ দফা মেনে নিলে তিনি ফিরে যেতে রাজি।

মো. এবাদুল্লাহ (৫৭) নামের আরেকজন বলেন, রাখাইন রাজ্যে এ মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই। এ কথাই তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

শালবাগান শিবিরের চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, গত দুই দিনে ২২১টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এসব পরিবারের বাসিন্দার সংখ্যা সাত শর মতো। কিন্তু শর্ত ছাড়া ফিরে যেতে রাজি হয়েছেন, এমন কাউকে তিনি খুঁজে পাননি।

পাঁচ দফায় অনড় রোহিঙ্গারা

গতকাল সকালে জাদিমোরা শালবাগান শিবিরে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা বার্মিজ ও ইংরেজি ভাষায় লেখা পাঁচ দফাসংবলিত প্রচারপত্র বিলি করছে। মো. আলমগীর নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, এ দেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার ৮০ শতাংশ পাঁচ দফার পক্ষে।

দফাগুলো হচ্ছে: ১. রোহিঙ্গারা আরাকানের (রাখাইন) স্থায়ী বাসিন্দা। সে কারণে রোহিঙ্গাদের ‘স্থানীয়’ স্বীকৃতি দিয়ে সংসদে আইন পাস করতে হবে। ২. আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র দিতে হবে। ৩. রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে। কেড়ে নেওয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। ৪. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং ৫. মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।

জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন জানান, প্রত্যাবাসনের বিপরীতে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব তোলা হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট মহলকে জানানো হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা শুরু হলে পরের কয়েক মাসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগেও অনেকে পালিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে কক্সবাজারে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। 

প্রত্যাবাসন ঘাটের চিত্র

গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত টেকনাফে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে নাফ নদী ছিল উত্তাল। এই নদীর তীরে টেকনাফের কেরুনতলী ঘাট। এখানে স্থাপন করা হয়েছে প্রত্যাবাসনকেন্দ্র। সকালে ও বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, ১১ আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা কেন্দ্রটি পাহারা দিচ্ছেন। আনসার কমান্ডার আইনুল হক বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গাকে কেন্দ্রে আনা হয়নি।’

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে স্থাপিত আরেকটি প্রত্যাবাসনকেন্দ্রও ফাঁকা। সেখানেও সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে আনা হয়নি।

Leave a Response