নিজেস্ব প্রতিবেদক: বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়লা আত্মসাৎ, নিম্নমানের কয়লা সরবরাহ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল ‘প্রমোদ ভ্রমণ’ করানোর মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর তদন্তাধীন, যারা ইতোমধ্যে কয়লা আত্মসাতের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে।
পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব: পারদ দূষণ ও পশুর নদের বিপর্যয়
কয়লা পরিবহনে বসুন্ধরা কোম্পানির চরম অরক্ষিত পদ্ধতির কারণে পশুর নদ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, নদীর পানিতে পারদের মাত্রা অনুমোদিত সীমার ১০ গুণ বেশি, যা জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য এক চরম বিপদ সংকেত। এর ফলে মাছের ডিম উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে, পাশাপাশি নদী ভাঙন ও বাস্তুচ্যুতি বাড়ছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, নিম্নমানের কয়লা ব্যবহারের কারণেই পরিবেশের ওপর এই বিরূপ প্রভাব। তিনি জানান, কানাই নগর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
হারবারিয়া এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজ ‘এমভি বসুন্ধরা লজিস্টিক ৩৮’-এ কয়লা স্থানান্তরের সময় ক্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা সরাসরি নদীতে পড়ছে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় নদী দূষণ তদারকির জন্য কেউ থাকে না। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার অধিকাংশই বালির মতো নিম্নমানের, যা টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী মানসম্পন্ন সাইজের কয়লা নয়। এই নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে সালফার, নাইট্রেট ও পারদ, যা সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইলিশ, লবণ এবং কোটি মানুষের জীবিকা আজ হুমকির মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকায় প্রশ্ন: দায় এড়ানোর চেষ্টা!
নদী দূষণ ও পরিবেশ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত বাগেরহাট জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, তিনি রামপালে আসার পর এখনও কেন্দ্রের আশপাশে তদারকি করার সুযোগ পাননি। তবে তিনি দাবি করেন, কয়লা নদীতে পড়া আটকাতে দুই জাহাজের মাঝে ত্রিপল বা পলিথিন জাতীয় কিছু ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে এই দাবির সত্যতা মেলেনি। লাইটার জাহাজ ও জেটি পল্টুনের মধ্যে কোনো ত্রিপল বা আবরণ দেখা যায়নি, যার ফলে কয়লা স্থানান্তরের সময় নদী দূষণ চলছে অবাধে।
বসুন্ধরার প্রমোদ ভ্রমণ ও দুর্নীতির জাল
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বসুন্ধরা কোম্পানি নিম্নমানের কয়লা সরবরাহ করলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ভয় ও মাসোহারার কারণে কোনো প্রশ্ন তোলেন না বা তদারকি করেন না। অভিযোগ রয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপ নিয়মিতভাবে রামপালের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মাসোহারা এবং প্রমোদ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেয়।
এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে। ২ মিলিয়ন মেট্রিক টনের নতুন টেন্ডারে বসুন্ধরার অংশ নেওয়ার সময়েই তাদের খরচে রামপালের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে কয়লার মান যাচাইয়ের জন্য নয় দিনের ইন্দোনেশিয়া সফরে পাঠানো হয়। পুরো ব্যয় ফ্লাইট, হোটেল, খাবার সবই বহন করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লিমিটেড। যাদের কয়লার মান যাচাইয়ের কথা, তাদেরই সরবরাহকারীর টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করানো হয়েছে। এর আগেও ২০২৩ সালে ৮ মিলিয়ন টনের কয়লা সরবরাহের চুক্তি পায় বসুন্ধরা। নিম্নমানের কয়লার কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি ও কয়লা সংকটে এখন পর্যন্ত অন্তত পনেরো বার বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
দুদকের প্রাথমিক প্রমাণ: কয়লা আত্মসাৎ নিশ্চিত
সবশেষ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অভিযান চালিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগেরহাটের দুদক কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেন্ডার অনুযায়ী কয়লা সরবরাহ না করে অনেক কম কয়লা সরবরাহ করেছে এবং বিপুল পরিমাণ কয়লা আত্মসাৎ করেছে—এমন প্রাথমিক প্রমাণ তাদের অনুসন্ধানী দল পেয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা আরও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি এখন বসুন্ধরা গ্রুপের ‘নিজস্ব সম্পত্তিতে’ পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবেশবিদদের মতে, কর্পোরেট প্রভাবমুক্ত না হলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু দূষণই নয়, দুর্নীতিরও প্রতীক হয়ে উঠবে। স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার সাথে দুদক তদন্ত চালালে এই বিশাল দুর্নীতির জট খুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এতো বড় দুর্নীতির পরও বসুন্ধরা এখনও বহাল তবিয়তে রামপালে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।