করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সাধারণ মানুষ ঘরে থাকতে সরকারি নির্দেশনা না মানায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ সাহসী হতে গিয়ে একটু বেশি সাহসী হয়ে গেছেন। তাদের বারবার ঘরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিনরাত যথেষ্ট কষ্ট করছে। কিন্তু কেন যেন মানুষ এটা মানতে চায় না। দেখা যায় এখানে বসে আড্ডা, ওখানে বসে গল্প। এটা করে তারা নিজেও ঝুঁকিতে পড়ছেন, অন্য দশজন মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলছেন।
শনিবার জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সরকারের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চেষ্টা হচ্ছে মানুষের জীবনটাও যেন চলে, তারা যেন সুরক্ষিত থাকে সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেশবাসীকে আহ্বান জানবো, সংসদ সদস্যসহ নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন তাদের সবাইকে বলবো স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, সবাই দয়া করে তা মেনে চলবেন। এই নির্দেশনা মেনে চললে নিজে যেমন সুরক্ষিত থাকতে পারবেন অপরকেও সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। কারও জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না। এজন্য আমি সবাইকে অনুরোধ করব নিজে সুরক্ষিত থাকুন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলুন।
মসজিদে না গিয়ে ঘরে বসেই এবাদত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঘরে বসে আল্লাহর দোয়া কামনা করেন। আল্লাহ তা কবুল করবেন। আল্লাহ তায়ালার শক্তি যে সবচেয়ে বড় শক্তি আমরা করোনাভাইরাসের শক্তি দেখেই বুঝতে পারি। অস্ত্র গোলাবারুদ কিছুই কাজে লাগছে না। সারাবিশ্ব করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে আবার যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে, সেই কামনা করি।
তিনি বলেন, ঝড় ঝাপটা দুর্যোগ তো আসে, আসবেই। সবসময় হতাশ হওয়া বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাহসের সঙ্গে এটা মোকাবিলা করতে হবে। যে যেখানে আছি, যার যার অবস্থানে থেকে এটা মোকাবিলা করতে হবে। সেই প্রস্তুতি সব সময় থাকতে হবে।
মানুষের ঘরে না থাকার প্রবণতার প্রসঙ্গ তুলে একটা উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে বলা হলো ঘরে থাকেন, অথচ ঘরে না থেকে বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলো। শিবচর থেকে টুঙ্গিপাড়া হাজির। এভাবে ভাইরাস টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে গেলো বরগুনা। আমরা বারবার অনুরোধ করছি, আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকেন। আমরা এটাকে একটা জায়গায় যদি ধরে রাখতে পারি এবং সেখান থেকে মানুষকে যদি সুস্থ করতে পারি, তাহলে কিন্তু এটা বিস্তার লাভ করবে না। কিন্তু, কেন যেন মানুষ এটা মানতে চায় না।
সংসদে যারা এসেছে সবাই মাস্ক পরে এসেছেন, কিন্তু বাইরে যারা আছেন তারা কী অবস্থায় আছেন এ ব্যাপারটা দেখতে হবে। এদের সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু কেন যেন মানুষ সেটা মানতেই চায় না।
করোনার পরিস্থিতি কতদিন থাকবে সেটা এখন বলা যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, কতদিন এই অবস্থা থাকবে তা কেউ জানে না। সারাবিশ্বই এটা বলতে পারছে না। এটা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, চিন্তা হচ্ছে অনেকে বলছেন শীতকালে বেশি হবে, গরমকালে বেশি থাকবে না, এখন বলা হচ্ছে গরমেও থাকবে। এর স্থায়িত্ব কতক্ষণ, একটা অদ্ভুত অবস্থা সারাবিশ্বে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সারা বিশ্বে কতইনা শক্তিশালী দেশ, কত তাদের শক্তিশালী অস্ত্র। কোনও কিছুই কাজে লাগলো না। একটা ভাইরাস যেটা চোখে দেখা যায় না, তার কারণে সারা বিশ্ব স্থবির। সারা বিশ্বের মানুষ ঘরে বন্দি। এ ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বোধহয় আর কখনও কেউ পড়েনি।
বিভাগীয় শহর জেলা ও উপজেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে পৃথক আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে বলেও সংসদকে জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, মোট আইসোলেশন ওয়ার্ড সংখ্যা ৬২০০। এছাড়া ভবিষ্যতের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে অনুরোধ করা হয়েছে যদি রোগীর সংখ্যা বাড়ে, তাহলে সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা করা।
সরকারের তিন ধাপে প্রণোদনা প্যাকেজ
করোনার অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সংকটটা যাতে কাটিয়ে উঠতে পারি, তার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। অর্থনৈতিকভাবে যে নেতিবাচক দিনগুলো সামনে আসতে পারে সেগুলো বিবেচনা করে আমরা কর্মসূচি নিয়েছি। দেশের সকল শ্রেণির মানুষের কথা বিবেচনা করে প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা দিয়েছি। অর্থনীতি যাতে গতিশীল থাকে, যার জন্য আমরা তিন ভাগে এই সুযোগটা দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের পরিবারগুলো যাতে খাদ্য কষ্ট না পায় সেজন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। দুর্ভিক্ষ যদি বিশ্বব্যাপী হয়, আমাদের দেশের মানুষ যাতে দুর্ভিক্ষে না পড়ে, তার জন্য আগাম তিন বছরের বিষয়টি মাথায় রেখেই প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের খাদ্যের অভাব নেই, অভাব হবেও না। কৃষি উৎপাদন যদি অব্যাহত থাকে তার জন্য আমরা নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ৪ পারসেন্ট হারে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
শিক্ষার্থীদের ধান কাটার আহ্বান
বোরো মৌসুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে, দিনমজুর যারা এখন কাজ পাচ্ছেন না, তাদের জন্য এটা একটা সুযোগ। তারা এখন ধান কাটতে যেতে পারেন। কেবল দিনমজুর নয় সকলেই যাওয়া উচিত। এখানে কেবল উঁচু-নিচু নয়, কাজ করা সকলের দায়িত্ব। ছাত্র-শিক্ষক সকলকে বিশেষ করে ছাত্রদের আমি বলবো, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেন একটু এগিয়ে আসে। সকলে মিলে ধানটা যদি কাটতে পারি, আমরা ভালোভাবে চলতে পারি। আমাদের খাবারের কোনও অভাব হবে না।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া আছে যারা যেখানে ধান কাটতে যেতে চায়, তাদের সেখানে পৌঁছে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব থেকে ইতিমধ্যে খাদ্য দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা যে যা পারি তরিতরকারির ব্যবস্থা করতে হবে। টবে হোক, ছাদে হোক, মাটিতে হোক, উৎপাদন করতে পারি আমরা। নিজেরা চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশকে দিতে পারি।
চিকিৎসাসেবার হটলাইনে ফোন দিয়ে অনেকে খাবারও চাচ্ছেন
চিকিৎসাসেবার হটলাইন নম্বরে ফোন দিয়ে অনেকে খাবারও চাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা হাত পাততে পারেন না কিন্তু বাড়িতে খাবার নেই, এমন তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আমি দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছি এই হটলাইনের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য। যদি কেউ সাহায্য চায়, সঙ্গে সঙ্গে যেন তা পৌঁছে দেওয়া হয়।
সরকারি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণের জন্য ৫০ লাখ কার্ড আমাদের দেওয়া আছে। আরও ৫০ লাখ কার্ড করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেটা শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি কার্ড করা হচ্ছে। এতে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ সুবিধা পাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর ২০৯টি দেশ আজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত সেখানে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। ডিসেম্বর মাসে এই রোগটির প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন আমাদের দেশে এটি আসেনি, তবে আমরা এর দিকে নজর রাখছিলাম। আর যখনই আমরা একটা সম্ভাবনা দেখেছি, তখনই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। কন্ট্রোল রুম খোলাসহ রোগটি মোকাবিলায় প্রস্তুতি আমরা গ্রহণ করি। কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে।
আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি
স্বাস্থ্য খাতে এত বড় দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আগে কখনও ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগে এরকম একটা ঝড় উঠবে তা আমাদের কল্পনাতীত ছিল। ভাইরাসসহ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পূর্বের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ এবং আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা থেকে পদক্ষেপ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা এখন পারদর্শী কিন্তু করোনাভাইরাস এটা একটা অদ্ভুত বিষয়, সত্যি কথা বলতে কী এর অভিজ্ঞতা সারাবিশ্বে কারও নেই। তারপরও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ অন্য দেশের চেয়ে যথেষ্ট ভালো আছে। বিশ্বে যেখানে দৈনিক হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে আমরা অনেকটা ভালো আছি।
তিনি বলেন, একটা ভাইরাস যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু যার কারণে সারা বিশ্বে স্থবির ধরনের ঘটনা বোধহয় আর কখনও দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর করোনা আক্রান্তদের পরীক্ষা থেকে চিকিৎসাসহ সব ধরনের খরচ সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে।
করোনা শনাক্তকরণের কিটের অভাব নেই
করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিটের অভাব হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন এ পর্যন্ত ৯২ হাজার কিট সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার বিতরণ করা হয়েছে, ৭২ হাজার মজুত রাখা হয়েছে। কিট সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করেন, অভাব হবে। অভাব হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই।
আরও হটলাইনের ব্যবস্থা হচ্ছে
করোনার চিকিৎসায় আরও হটলাইনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, হটলাইনের নির্ধারিত নম্বরগুলোর মাধ্যমে চিকিৎসকরা পালাক্রমে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ ইউএন-এইড, ইউকে-এইডসহ অনেক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বাংলাদেশের পাশে এসেছেন বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বিশেষ ব্যবস্থায় পালন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বিশেষ ব্যবস্থায় পালনের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য আমরা ব্যাপকভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। জন্মবার্ষিকী পালনের সুযোগটা আমার জন্য বিরল। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সারা বিশ্বের মানুষকে যেন বন্দি করে ফেললো। করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এ কারণে দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে সেই জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব জনসমাগমের মাধ্যমে আর করিনি। আমরা কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনে বিশেষ ব্যবস্থায় পালন করি। যার কারণে আমরা সকল কর্মসূচি স্থগিত করি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসে উদযাপন করেছি।