ভারতীয় রুপির রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। বর্তমানে রুপিকে ধরে ফেলার উপক্রম করেছে বাংলাদেশি টাকা। ১০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে ৮৬ রুপি। যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। অপরদিকে ১০০ রুপির দাম গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫ টাকার সামান্য বেশি। আবার লেনদেন হুন্ডির মাধ্যমে হলে এর বেশিও মিলছে।
এতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ ভারতের বড় বড় শহরের শপিং মলে বাংলাদেশিদের কেনাকাটা বেড়েছে। ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বেড়েছে চোরাচালানও। বিশ্বে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে যে ওঠানামা চলছে তাতে বাংলাদেশি টাকা ডলারের বিপরীতে বেশি দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে বলেই রুপির তুলনায় তার দর বেড়েছে। এর ফলে ১ মার্কিন ডলার প্রতি ভারতীয় রুপির দাম ৭২ টাকা ৩ পয়সা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে ভারতের রফতানি আরও বাড়বে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যারা ডাক্তার দেখাতে, অস্ত্রোপচার করাতে, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে ভারতে যাবেন তাদের জন্য এটা বড় সুখবর। কারণ টাকা বদলানোর পর তাদের হাতে নগদ রুপি এখন অনেক বেশি আসবে।
ঠিক দুই বছর আগে ২০১৩ সালের আগস্টেও অনেকটা একইরকম রুপির বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার দাম বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এখন ২০১৯ সালে এসে রুপি-টাকার বিনিময় হার কোথায় এসে দাঁড়াবে তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে দুই দেশের বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল যে ভারতে মুদ্রার দাম কমছে এমনটা নয়। সারাবিশ্বেই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কমছে মুদ্রার দাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য-যুদ্ধের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। বেশ কিছু সময় ধরেই চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ। হুয়াওয়ে বিতর্কের পর চরমে পৌঁছায় সেই বিরোধ। গত শুক্রবার আমেরিকা থেকে আমদানি করা প্রায় ৭৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক বসানোর ঘোষণা করে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা জানিয়ে দেন, চীন থেকে আমদানি করা প্রায় ৫৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর বাড়তি কর বসানো হবে। দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে চীনের মুদ্রাতেও। গত ১১ বছরে সব থেকে বেশি কমেছে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের দর। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সংঘাতের প্রভাব পড়ছে। বড় ঝুঁকি নেয়া থেকে পিছিয়ে আসছেন বিনিয়োগকারীরা। বাড়ছে অপরিশোধিত তেলের দাম। এর প্রভাবেই দাম কমছে ভারতসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রার।
মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছে, আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারতে রুপির মান নিম্নমুখী হতে শুরু করে। ফলে রুপির বিপরীতে টাকার মূল্যমান বাড়তে থাকে। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সংকট, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে রুপির এই দরপতনে বাংলাদেশি টাকার মান বেড়েছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি ১০০ টাকায় সমান সমান ভারতীয় ১০০ রুপি পাওয়া যেত। এরপর টাকার মান কমতে থাকে। একপর্যায়ে তা রুপির চেয়ে অর্ধেকেরও কমে এসে দাঁড়ায়। এ সপ্তাহে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দাম একটা সময় পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে গিয়েছিল। অথচ সেই একই সময়ে বাংলাদেশি টাকার বিপীরতে রুপির পতন হয়েছে যৎসামান্য। বর্তমানে রুপির বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার দাম এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে আর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যেও তার সরাসরি প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যটা ডলারে হয় বলেই রুপির পতনের প্রভাবটা সীমিত হবে। রুপির দাম কমায় রফতানিকারী হিসেবে ভারতের ‘কমপিটিটিভনেস’ কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু চট করে সেটার সুফল হয়তো বোঝা যাবে না। কারণ এই ধরনের আমদানি বা রফতানির পরিকল্পনাটা হয় অনেক আগে থেকে। অর্ডার ডেলিভারির ছয় মাস আগেই হয়তো দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরও সারা হয়ে যায়।
এদিকে দরপতনের কারণে অনেকেই টাকা দিয়ে রুপি কিনে রাখছে। পর্যটনসহ বিভিন্ন কারণে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশিরাও বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে। একই কারণে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক পাসপোর্টধারী যাত্রী ভারতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে।
বেনাপোল সীমান্তের ওপারে ভারতের পেট্রাপোলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী এন বিশাস অ্যান্ড কোং এর প্রতিনিধি সুপ্রদীপ বিশ্বাস ও মহম্মদ এন্টারপ্রাইজের মালিক সুমন মন্ডল জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশি ১০০ টাকায় ভারতীয় ৮৬ রুপি পাওয়া যাচ্ছে। মুদ্রা বিনিময়ের এই হার গত তিন যুগের মধ্যে রেকর্ড।