আমি মাফরুদা খান এরীন। আমি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিলাম একজন পুরোদস্তুর গৃহিনী। লেখাপড়া শেষ করে সংসারী হবার পরে কখনো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখিনি। তবে এক সময় নিজের কিছু করার তাগিদ নিয়ে ১৯৯৬ সালে দেশের জন্য কিছু না করতে বিষন্নতা থেকে স্বজন বন্ধুদের সাহসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে লন্ডন প্রেস ইন্টার ন্যাশনাল নামের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমে পরিবারের সদস্যরা অনেক বিরোধিতা করেছিল যে, কোনো কিছুই করার দরকার নেই সংসার তো ভালোই চলছে, এই বলে। স্কুল করতে হবে কেনো, এসব দিয়ে কি হবে এমন বহু কথা শুনতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে।
কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ধীরে ধীরে শুরু করি। বহু কষ্টে দাড় করানো এখন সেই স্কুলটিতে এখন প্রায় একশজন শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী চাকুরীরত আছেন। কিন্ত কভিট-১৯ অর্থ্যাৎ করোনা ভাইরাসের কারনে গত ১৫ মার্চ স্কুলটি বন্ধ করে দিতে হয়।
আমরা জানী নারী উদ্যোক্তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি ।বাংলাদেশে বছরে যে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে মনে করি আমি মাফরুদা খান এরীন তাদের একজন। নারী উদ্যোক্তাদের সবাই যে তার মতো সফল হন, তা নয়। ব্যর্থতার কাহিনীও অনেক আছে। তবে বর্তমানে করোনা পরিস্থীতির কারনে ক্ষুদ্র আর মাঝারি উদ্যোক্তাদের সামনে বিরাট চ্যালেন্জ। আর এই দূযোর্গপূর্ন সময়ে আমি মনে করি উদ্যোক্তা যদি হন নারী, তার সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। বাধা আরও অনেক। আমি মার্চ মাস কোন রকম চালিয়েছি ।
এই মাস বা সামনের মাসগুলোতে কিভাবে চালাব জানিনা । যারা এই টাকা দিয়েই সংসার চালায় তারা কি ভাবে চলবে ! অভিভাবক বৃন্দ বাসা থেকে বের হতে পারছেন না তাই তারা বেতন দিতে পারছেন না , কেউ কেউ চাকুরী চুত্য বা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্থ । বাড়ি ভাড়া, বেতন না দিয়ে স্কুলটি পরিচালনা খুবই কঠিন । আমার আরো দুইটি বিউটি পার্লার ও একটি বুটিক শপ আছে । ২৫ এ এপ্রিল ইকবাল রোড পার্লার টি একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি । কবে খুলবো কেউ জানে না ।
ওখানে ইনভেস্টমেন্ট ছিল ৫ কোটি টাকা। আমার প্রতিষ্ঠানের বাড়ি ভাড়া দের লাখ টাকা , কর্মচারী ও বিউটিসিয়ানদের বেতন ৬ লক্ষ টাকা , কাঁচামাল সহ ৯ লক্ষ টাকা । বুটিক বন্ধ থাকায় এই মুহুর্তের লোকসান ৭ লাখ টাকা । গুলশান পার্লার ২০ লক্ষ টাকা । স্কুল ৩০ লক্ষ টাকা । আমি কি ভাবে এতো টাকা বহন করবো ?
করোনা আক্রান্তের কারনে বর্তমানে বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি এই ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যেক্তাদের কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়? কতটা কঠিন তাদের এই লড়াই। সরকার প্রনোদনা ঘোষনা করেছেন। কিন্ত কারা পাবেন এসব প্রনোদনা? আমরা কি পাবো? পেলে কিভাবে? প্রক্রিয়া কি? এখানেও কি চেনা লোক দেখে দেখে সরকারী সহযোগীতা দেয়ার বিষয়টি ঘটবে?
বেশিরভাগ উদ্যোক্তার অবস্থা একেবারেই খারাপ। সব বন্ধ হয়ে যাবার কারনে তাদের দিন আনতে পানতা ফুরোবে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পুঁজির সংকটে পড়বে সবাই।
প্রনোদনার কাজটা শুনেছি শুরু করতে হবে ব্যাংক থেকে। সেই ব্যাংকে নাকি আবার কাকে কাকে টাকা দিতে পারবে সেটা নিয়ে চলবে চুলচেড়া পরীক্ষা। একজন ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা ব্যাংক ডিলিংস টা কি বোঝে? সে কি জানে কি করে ব্যাংক থেকে সরকার ঘোষিত প্রনোদনা নিতে হবে? আমি নিশ্চিত বেশীরভাগই জানে না। সুতারাং কি হবে? সেই লাভের গুড় ধনীদের পেটে। যারা সবসময় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে লুটপাট করে খেতো তারাই করোনার কারনে সরকার ঘোষিত প্রনোদনাটা ভাগেযোগে খেয়ে ফেলবে।
সত্যি বলছি সরকার আমাদের মতো উদ্যেক্তাদের দিকে না তাকালে লাখ লাখ মানুষ পথে বসে যাবে যে সেটা আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি। এই পথ চলাটা অনেক কঠিন । অনেক কষ্ট করে সবার। সাথে ভয়াবহ দুশ্চিন্তা সবার মনে। কি হবে সামনে? কি করবো? কতদিন সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিবো আমরা? সবাইকে নিয়েই তো আমাদের ছোট ছোট উদ্যেক্তা পরিবার। আমরা চাইনা কোনো কারনে আমাদের পরিবারের কোনো সদস্য আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিক। আমরা আগের মতো সবাইকে নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে চাই। কিন্তু সেজন্য দরকার সত্যিকার অর্থে সরকারী সহযোগীতা।
আমিও ভেঙে পড়ি নি। কিন্তু কতদিন? এ লড়াই করে টিকে রয়েছেন আবার অনেক উদ্যোক্তা টিকতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আমি টিকতে না পেরে একটা ব্যবসাটা ছেড়ে দিলাম,বাকিগুলো?
বুঝেগেছি পুঁজির সংকট ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা । বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে হিসাবে, বাংলাদেশে এখন ৬০ লাখের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাদের বড় অংশটি নারী। এদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে আরো কয়েকগুণ মানুষ আর বছরে যোগ হচ্ছে আরো প্রায় ৫০ হাজার উদ্যোক্তা। তাদেরও কি হবে? সরকার কি শুধু তেলে মাথায় তেল দিবে?
পরিশেষে বলি, দয়া করে আমাদের জন্য কিছু ভাবুন। আমি বা আমরা এক নই। লাখলাখ পরিবার আমাদের মতো ক্ষদ্র উদ্যেক্তাদের সাথে সম্পৃক্ত। সহযোগীতা না করলে সবাই পথে বসে যাবে। বিপদে পড়বে রাস্ট্র সমাজ। সামাজি অবক্ষয় শুরু হবে বেকার বেড়ে গেলে। ভিক্ষা চাইনা। আপদকালীন সময়ে সহযোগীতা চাই। আমরা ঠিকই নিজেদের মতো করে ভবিষ্যতে সব ঠিক করে ফেলতে পারবো। কিন্তু এখন বড় বিপদ। সরকারকেই হাল ধরতে হবে। আমাদের বাচাতে হবে। আমরা বাচলে সমাজ বাচবে রাস্ট্র শক্তিশালী হবে।
লেখক: মাফরুদা খান এরীন, ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা