মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে অনেক পুরোনো খেলোয়াড় মাহাথির মোহাম্মদ। অন্যান্যবারের মতো এবারও একাই খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। চিত্রনাট্যও সাজানো হয়েছিল। নিজেই শূন্যস্থান তৈরি করেছিলেন তাই। কিন্তু শেষতক বেশি খেলতে গিয়ে নিজেই ল্যাং খেলেন।
এবারের চিত্রনাট্যে আপাতদৃষ্টিতে শুরু থেকেই মাহাথির সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। শাসক জোট পাকাতান হারাপানের অনৈক্য প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। সঙ্গে ছিল প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুরোনো দ্বৈরথ। যখন প্রতিপক্ষ শিবিরে বিভক্তি প্রবল, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিলেন ডক্টর এম। বলে দিলেন, ক্ষমতালিপ্সা নেই বলেই পদ ছেড়েছেন। আবার এ-ও বললেন, সুযোগ পেলে আবার বসতে চান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে। এর মধ্যে দেশটির রাজা তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও দিলেন। সব মিলিয়ে মাহাথির তখন মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকা স্বচ্ছন্দে পালন করার সুযোগ পেলেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাহাথিরের বিপক্ষে ছিল অনেকে। এক দিকে পাকাতান হারাপান চাইছিল তিনি যেন ক্ষমতা থেকে সরে যান। আনোয়ার ইব্রাহিম চাইছেন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে। আবার অন্য দিকে বিরোধী জোট বারিসান ন্যাশনালও ক্ষমতার ভাগীদার হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। দেখাটাই স্বাভাবিক। দশকের পর দশক ধরে যে ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, পাকাতান হারাপানের কারণে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা তাদের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। তাই উঠে গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়প্রধান রাজনীতির ধুয়া। এর সঙ্গে আবার আছে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা। সব মিলিয়েই আস্তে আস্তে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে দূরে সরে গেলেন মাহাথির। কারণ, একসঙ্গে এত প্রতিপক্ষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রন্টে যুগপৎ লড়াই চালিয়ে জেতাটা সহজ কাজ নয়।
মুহিদ্দিন ইয়াসিন। ছবি: রয়টার্সতবে খেলোয়াড়ের নাম মাহাথির মোহাম্মদ বলেই আগেই শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। কারণ, ৯৪ বছর বয়সী এই রাজনীতিক ২০১৮ সালের নির্বাচনে বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখিয়ে শিষ্য নাজিব রাজাককে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু এবার আরেক শিষ্য মুহিদ্দিন ইয়াসিনের কাছে সাময়িক পরাজয় মানতেই হলো তাঁকে।
মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন মুহিদ্দিন ইয়াসিন। নিয়োগপত্র এসেছে রাজকীয় প্রাসাদ থেকে। রাজা বলছেন, তাঁর বিশ্বাস, মুহিদ্দিনই পারবেন পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে। ভড়কে দেওয়ার মতো এই সিদ্ধান্তের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মাহাথির বলে বসেন, ইয়াসিনকে পার্লামেন্টে দিতে হবে আস্থা ভোটের পরীক্ষা এবং শিগগিরই এই অগ্নিপরীক্ষা চান তিনি। কারণ, পোড় খাওয়া মাহাথিরের বিশ্বাস, ওই পরীক্ষায় জয়ী হবেন তিনিই। সঙ্গে এ-ও বলেন, ‘নিজেকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার বলে বোধ হচ্ছে।’ তুলে দেন মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কও।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন বক্তব্য দিয়ে এক কথায় রাজার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন মাহাথির। আবার ওদিকে আনোয়ার ইব্রাহিমও ঝগড়াঝাঁটি ভুলে চলে আসেন গুরুর পাশে। জানিয়ে দেন, মাহাথিরের পাশেই আছে তিনিসহ পুরো পাকাতান হারাপান। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে তখন শুরু হয় নতুন নাটকীয়তা।
আনোয়ার ইব্রাহিম। ছবি: এএফপিঅবশ্য কিছুদিন আগেও মাহাথিরের সঙ্গে একই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মুহিদ্দিন ইয়াসিনের দাবার চাল তখনো বাকি ছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই কাজ শুরু করে দেন তিনি। মুহিদ্দিন এরই মধ্যে পার্লামেন্টের অধিবেশন দুই মাস পিছিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, সরকার সামলাতে তাঁর সময় দরকার। এক সরকারি ঘোষণায় জানা গেছে, নতুন মন্ত্রিসভা নিয়োগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থাকবে ইয়াসিনের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্লেষকদের মত, পার্লামেন্টের অধিবেশন অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিয়ে আসলে সুবিধা আদায় করতে চাইছেন মুহিদ্দিন। এই সময়ের মধ্যে আইনপ্রণেতাদের নিজের সমর্থনে টেনে আনার চেষ্টা করবেন তিনি।
কিন্তু কীভাবে সুবিধা আদায় করবেন মুহিদ্দিন? এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো মালয়েশিয়াতেও প্রকৃত গণতন্ত্র নেই। সেখানে প্রধানমন্ত্রী পদটি চূড়ান্ত ক্ষমতাধর। রাজা ও সুলতান আছেন বটে, তবে তাঁদের সাংবিধানিক ক্ষমতা সীমিত। মধু যেখানে বেশি থাকবে, মৌমাছির তো তার আশপাশেই ঘোরার কথা! তাই আস্থা ভোটে দাঁড়ানোর আগে মুহিদ্দিনের বাড়তি সময় আদায়ের বিষয়টির মোজেজা বোঝা জলের মতো স্বচ্ছ। এর মধ্য দিয়ে মাহাথিরের আবার ক্ষমতায় ফেরার অঙ্কটা আরও জটিল হয়ে উঠছে।
এর সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক ও অর্থনৈতিক সংকট। মালয়প্রধান ভোটের রাজনীতি মাহাথিরও করেছেন। তাঁর আমলে মালয় সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছে। কিন্তু এই মাহাথিরই যখন একটি বহুত্ববাদী জোট পাকাতান হারাপানের হয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন বিরোধীরা তা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার শুরু করল। তাঁর পুরোনো দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনেও (ইউএমএনও) মালয় প্রাধান্য আছে। আর মুহিদ্দিন ইয়াসিন তো একদা বলেই দিয়েছিলেন—মালয় আগে, মালয়েশিয়া পরে! সুতরাং এত প্রতিযোগীর ভিড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়দের সমর্থন আবার নিজের দিকে টেনে আনা মাহাথিরের জন্য এখন কিছুটা কষ্টসাধ্য।
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে অনেক পুরোনো খেলোয়াড় মাহাথির মোহাম্মদ। ছবি: রয়টার্সপাকাতান হারাপান সরকারের আমলে অর্থনীতিতেও সুবিধা করতে পারেননি মাহাথির মোহাম্মদ। দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। ট্যাঁকে টান পড়লে ভোটব্যাংক দেউলিয়া হতে কতক্ষণ?
কিছুটা স্বস্তি দিতে এবং খেলার ময়দানে জেতাতে সাহায্য করতে পারত মালয়েশিয়ার রাজপ্রাসাদ। কিন্তু দেশটির রাজা ও নয়জন সুলতানের সঙ্গে মাহাথিরের টানাপোড়েন আছে ঐতিহাসিকভাবে। মালয়েশিয়ায় রাজা কখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তিনি শুধু মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারেন। নিন্দুকদের মত—তাই বলে রাজা ও সুলতানেরা রাজনীতিসচেতন নন, এমন তো নয়। ১৯৮৩ ও ১৯৯৩ সালে এই রাজকীয় ক্ষমতার পরিধি সংকুচিত করতেই সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন ডক্টর এম। এহেন ব্যক্তির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর পক্ষে কি তিতা স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভব?
তারপরও মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক জীবনে পূর্ণ যতিচিহ্ন এঁকে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, সব চেনা বিরোধী খেলোয়াড়ের সঙ্গে এখনো মাঠে আছেন তিনি। শিষ্যরা চাল দিলে, গুরু কি বসে থাকবেন? আর কে না জানে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে!
তথ্যসূত্র: নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ, ব্লুমবার্গ, গার্ডিয়ান, বিবিসি, দ্য স্টার ও টাইম ম্যাগাজিন