স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর কাশ্মিরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন কাশ্মিরিরা। সেখানকার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক সাংবাদিক। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে মোটা তার ও লাঠি দিয়ে মারধর এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে। নির্যাতিতরা ওই সাংবাদিককে ক্ষতচিহ্নগুলো দেখিয়েছেন। তবে বিবিসি ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিপীড়নের অভিযোগ যাচাই স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই অভিযোগগুলোকে ‘ভিত্তিহীন ও প্রমাণসাপেক্ষ নয়’ বলে দাবি করেছে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ অধিকার বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে দিল্লি। ওই দিন সকাল থেকে কার্যত অচলাবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হয় পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মির উপত্যকা। সেখানে কারফিউ জারি ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অতিরিক্ত হাজার হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও অ্যাক্টিভিস্টসহ তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। অনেককে রাজ্যের বাইরের কারাগারে রাখা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব পদক্ষেপ শুধুই রাজ্যের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই নেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে তিন দশক ধরে স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। ভারতের অভিযোগ, ওই অঞ্চলের জঙ্গিদের সহায়তা করে পাকিস্তান। যেই অভিযোগ কাশ্মিরের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করা পাকিস্তান সবসময়ই অস্বীকার করে আসছে।
ভারতের অনেক মানুষ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলে সমর্থন দিয়ে স্বাগত জানায়। ‘সাহসী’ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করে। এই সিদ্ধান্তকে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম ব্যাপক সমর্থন করে।
বিবিসি সাংবাদিক সামির হাশমি দক্ষিণ কাশ্মিরের অন্তত ৬টি গ্রামে ঘুরে দেখেছেন। ওই গ্রামগুলোতে গত কয়েক বছরে ভারতবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত। তিনি বলেন, ‘ওই গ্রামগুলোর সবকটার বাসিন্দাদের কাছ থেকেই নির্যাতনের একই ধরণের বক্তব্য শুনতে পেয়েছি।’ তবে রোগীদের ওই ক্ষতচিহ্নের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। গ্রামবাসীরা সাংবাদিককে তাদের শরীরের ক্ষত দেখিয়ে দাবি করেছেন, যে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা। আরেকটি গ্রামের বাসিন্দা জানায়, কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরপরই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাড়ি তল্লাশি করতে আসে।
নির্যাতেনর শিকার দুই ভাই অভিযোগ করেন, তাদেরকে তুলে নেওয়ার পর এলাকার বাইরে নিয়ে আরও কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে দাঁড় করানো হয়। অন্যান্যদের মতো ওই দুই ভাইও নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। তাদের একজন বলেন, ‘তারা আমাদের ব্যাপক মারধর করে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি: আমরা কী করেছি? আপনারা গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমরা যদি মিথ্যা বলে থাকি, আমরা যদি কোনও অন্যায় করে থাকি? কিন্তু তারা আমাদের কোনও কথাই শোনেনি, কিছু বলেনি, তারা আমাদের মারতেই থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার শরীরের প্রতিটি অংশে তারা আঘাত করে। তারা আমাদের লাথি দেয়, লাঠি ও বিদ্যুতের তার দিয়ে মারে, বৈদ্যুতিক শকও দেয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়। রড দিয়ে মারার সময় আমরা যখন চিৎকার করছিলাম, তখন আমাদের মুখ বন্ধ করার জন্য মুখে কাঁদা ভরে দেয়। আমরা তাদের বারবার বলতে থাকি আমরা নির্দোষ। তাদের জিজ্ঞাসা করি কেন আমাদের নির্যাতন করছে।কিন্তু তারা আমাদের কোনও কথা শুনেনি। আমি তাদের বলি, মারধর করবেন না, একেবারে গুলি করুন। আল্লাহর কাছে আমি মৃত্যু কামনা করি কারণ নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না।’
গ্রামের আরেক তরুণ বলেন, কে কে পাথর ছুড়েছে তাদের নাম বলতে চাপ দিতে থাকে সেনাবাহিনী। গত কয়েক দশকে কাশ্মির উপত্যকায় এই তরুণ-কিশোররাই নাগরিক আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সে এ সম্পর্কে কিছুই জানে না জানানোর পর সেনারা তাকে চশমা, কাপড় ও জুতা খোলার নির্দেশ দেয়।
তরুণ বলেন, ‘আমার কাপড় খুলে নেওয়ার পর তার ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে আমাকে পিটায় সেনারা। আমি যখনই অচেতন হই, তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়। তারা যদি আমার সঙ্গে এমন আবার করে, আমি যেকোনও কিছু করতে প্রস্তুত। আমি বন্দুক তুলে নেব। এটা প্রতিদিন সহ্য করা যায় না।’
ওই তরুণ আরও বলেন, গ্রামের সবাইকে সতর্ক করতে বলেছে সেনারা। সেনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কেউ অংশ নিলে তার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে বলে জানায় তারা।
বিবিসির কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানায়, “তাদের বিরুদ্ধে আনা ‘অভিযোগ অনুযায়ী কোনও নাগরিকের সঙ্গে জবরদস্তি করেনি সেনাবাহিনী।’” সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্ণেল আমান আনন্দ বলেন, ‘এধরণের কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। এই অভিযোগগুলো শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা থেকে সৃষ্ট। জনসাধারণের নিরাপত্তায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর নেওয়া অভিযানের কারণে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’
বিবিসির সাংবাদিক বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখতে পান যে, সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও ভারত সরকার এদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে গ্রামবাসীদের ভাষায়, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নয়, স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা। কাশ্মিরের এই অঞ্চলের একটি জেলাতেই ফেব্রুয়ারিতে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়। এই অঞ্চলেই ২০১৬ সালে জনপ্রিয় কাশ্মিরি যোদ্ধা নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হয় (যাকে ভারত জঙ্গি বলে আখ্যা দিয়েছে), যার পর কাশ্মিরি তরুণদের অনেকেই ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়।
কাশ্মিরের ওই অঞ্চলে রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প। সেখানে জঙ্গি ও সশস্ত্র সংগ্রামকারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। এই সব অভিযানে গ্রামবাসী নির্যাতনের শিকার হয় বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
অন্য গ্রামের এক তরুণ জানায়, জঙ্গিদের খবর জোগাড় করে না দিলে তার নামে অভিযোগ তৈরি করা হবে বলে তাকে হুমকি দিয়েছিলো সেনা সদস্যরা। এই কাজে অস্বীকৃতি জানালে তাকে এমন নির্যাতন করা হয় যে দু’সপ্তাহ পরেও সোজা হয়ে বিছানায় শুতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘এটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমার বাড়ি ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না। তারা আমাদের এমনভাবে মারে যেনও আমরা মানুষ না, পশু।’
নির্যাতনের শিকার আরও একজন তার ক্ষতচিহ্নগুলো দেখিয়েছেন বিবিসি সাংবাদিককে। তিনি জানান, ১৫ থেকে ১৬ সেনা সদস্য তাকে মাটিতে ফেলে তার, বন্দুক, লাঠি ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছে। বলেন, ‘আমার জ্ঞান প্রায় ছিলই না। তারা আমার দাড়ি ধরে এত জোরে টানে যে আমার মনে হচ্ছিল যে আমার দাঁত উপড়ে আসবে।’
অন্য গ্রামের আরেক তরুণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওই সাংবাদিক। ওই তরুণ জানায়, দুই বছর আগে কাশ্মিরে ভারত শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দিয়েছেন তার ভাই। তার অভিযোগ, তাকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, যার ফলে তার এক পা ভেঙে গেছে। আমার হাত-পা বেঁধে উপুড় করে ঝুলায় তারা। এরপর দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমাকে মারতে থাকে।’
তবে সেনাবাহিনী এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা এক বিবৃতি জানায়, তারা ‘পেশাদার একটি বাহিনী যারা মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞাত ও সম্মান করে’। তারা ‘অভিযোগগুলো দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত করছে।’ সেনাবাহিনী আরও জানায়, গত পাঁচ বছরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) উত্থাপিত ৩৭টি অভিযোগের মধ্যে ২০টি ‘ভিত্তিহীন’ প্রমাণিত হয়েছে। আর ১৫টি অভিযোগের তদন্ত চলছে এবং মাত্র তিনটি অভিযোগ তদন্তযোগ্য হিসেবে পাওয়া গেছে। এতে কারো দোষ প্রমাণিত হলে, শাস্তি হবে।
তবে গত তিন দশকে কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক অভিযোগের ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুইটি কাশ্মিরি মানবাধিকার সংস্থা। ওই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে ৪৯ পাতার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওই সংস্থা। তবে ওই প্রতিবেদনটিও প্রত্যাখ্যান করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
কাশ্মিরিদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তদন্তের উদ্দেশ্যে তদন্ত কমিশন গঠন করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।