‘নো ডিল ব্রেক্সিট’, অর্থাৎ কোনো চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া ঠেকানোর চেষ্টায় ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ২১ জন এমপি শামিল হয়েছেন বিরোধী দলের কাতারে; আর এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটিতে হেরে গেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
জনসন সরকারের ব্রেক্সিটনীতির বিরোধীরা মঙ্গলবার পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব তোলেন, যাতে ব্রেক্সিট আরও পিছিয়ে দিয়ে যুক্তরাজ্যের স্বার্থ রক্ষা করে একটি বিচ্ছেদ চুক্তি চূড়ান্ত করার সময় পাওয়া যায়।
বিবিসির খবরে বলা হয়, হাউজ অব কমন্সের ভোটাভুটিতে সেই প্রস্তাবের পক্ষে ৩২৮ ভোট পড়ে, আর বিপক্ষে পড়ে ৩০১ ভোট।
এর মানে হল,ওই প্রস্তাব টিকে যাওয়ায় আপাতত বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ চলে গেল এমপিদের হাতে। এখন তারা ব্রেক্সিট পিছিয়ে দেওয়ার বিল নিয়ে এগোতে পারবেন।
ভোটাভুটিতে হারের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আবারও হুমকি দিয়েছেন, এমপিরা তার প্রস্তাবে সায় না দিলে তিনি আগাম নির্বাচনের পথে যাবেন।
আর বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ব্রেক্সিট পিছিয়ে দেওয়ার বিলটি পাস করতে হবে প্রধানমন্ত্রী নতুন নির্বাচন ডাকার আগেই।
২০১৬ সালের ২৩ জুন এক গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চার দশকের সম্পর্কোচ্ছেদের পক্ষে রায় দেয় যুক্তরাজ্যবাসী। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই জোট থেকে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য আলাদা হবে এবং এরপর ইইউভুক্ত বাকি ২৭টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে, সেসব বিষয়ে ব্রিটিশ এমপিরা একমত হতে না পারায় ইইউ থেকে এখনও ‘মুক্তি’ মেলেনি ব্রিটেনের।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)বেঁধে দেওয়া সর্বশেষ সময় অনুযায়ী,বিচ্ছেদ প্রশ্নে ব্রিটেন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারুক বা না পারুক, ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর হবে।
সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হবে হুট করেই, বিচ্ছেদ পরবর্তী সম্পর্ক কেমন হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কর কাঠামো কেমন হবে, কূটনৈতিক সম্পর্কের ধরনই বা কী হবে- সেসব বিষয় অনির্ধারিতই থেকে যাবে। এটাকেই বলা হচ্ছে ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’।
গত জুলাইয়ের শেষে টেরিজা মের হাত থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব বুঝে নেওয়া বরিস জনসন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে অবিচল। ব্রিটেনকে তিনি ‘নো ডিলের’ দিকেই নিতে চাচ্ছেন, যা নিয়ে বিরোধী দলের পাশাপাশি জনসনের নিজের দলেরও অনেকের আপত্তি আছে।
এ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই গ্রীষ্মের ছুটি শেষে মঙ্গলবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন বসে। চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ আটকাতে অধিবেশনের শুরুতেই সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব আনে বিরোধী দল। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীসহ কনজারভেটিভ পার্টির মোট ২১ জন এমপি ওই প্রস্তাবের পক্ষে যোগ দেন।
ভোটে হারার পর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বলা হয়, যারা দলের মতের বিরোধিতা করছে, তাদের পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হবে।
বিবিসি লিখেছে, বহিষ্কার আর আগাম নির্বাচনের হুমকি বিদ্রোহী এমপিদের লাইনে আনতে পারবে বলেই জনসন সরকার আশা করছে।
কনজারভেটিভ পার্টির এই বিদ্রোহীদের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী কেন ক্লার্কও আছেন। বিবিসি নিউজনাইটে তিনি বলেছেন, তিনি এখনও নিজেকে ‘কনজারভেটিভ পার্টির মূল ধারার একজন’ বলে মনে করেন, কিন্তু এখনকার এই দলকে তিনি চেনেন না।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ‘অশিষ্ট চরিত্রের’ কারণে মন্ত্রিসভার যে চেহারা দাঁড়িয়েছে, এতটা ‘ডানপন্থি সরকার’ আর কখনও কনজারভেটিভ পার্টি গঠন করেনি বলে মন্তব্য করেন ক্লার্ক।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, বিরোধী এমপিরা যে বিল তুলেছেন, তাতে ব্রেক্সিট আলোচনার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে। তাতে অনিশ্চয়তা, দ্বিধা আর বিভ্রান্তি বাড়া ছাড়া ব্রিটেনের কোনো লাভ হবে না।
পার্লামেন্ট সদস্যদের তিনি বলেছেন, তার সঙ্গে একমত হতে না পারলে অক্টোবরেই আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না তার। জনগণই তখন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিবিসি লিখেছে, জনসনের সেই ইচ্ছাও খুব সহজে পূরণ হবে না, কারণ ২০১১ সালের একটি আইনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন দিতে গেলে ৬৫০ সদস্যের পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেতে হবে বরিস জনসনকে। আর সেক্ষেত্রে তার বিরোধী দলে লেবার পার্টিরও সমর্থন লাগবে।
কিন্তু লেবার নেতা করবিন ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, আগাম নির্বাচনের আলোচনা ওঠার আগেই ব্রেক্সিট পেছানোর বিল পার্লামেন্টে পাস করাতে হবে, যাতে ‘নো ডিল ব্রেক্সিটের’ সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। তার দাবি, ব্রিটেনের অধিকাংশ ভোটারও ‘নো ডিল ব্রেক্সিটের’ বিপক্ষে।