করোনা–সংক্রমিত রোগীদের অনেককেই বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে হয়। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে শুধু হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। বাড়িতে বসে চিকিৎসার মাধ্যমেই অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিক সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সংক্রমণের সংখ্যা যেহেতু বেড়েই চলেছে এবং যেকেউ যেকোনো সময়ে সংক্রমিত হতে পারেন, তাই আপনার বাসাটিকে সেভাবে প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিসার্চ প্রজেক্টের ওপর ভিত্তি করে এ ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ দিতে চাই।
বাড়িতে বসে করোনা বা কোভিড–১৯–এ সংক্রামিত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে বাসার পরিবেশটিকে স্বাস্থ্যকর ও সেবা উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আপনার বাসার আয়তন যাই হোক না কেন, তার মাঝেই প্রয়োজনীয় আয়োজন ও সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রোগীর সেবা ও পরিচর্যার জন্য আলাদা স্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের দিকেও বাড়তি নজর থাকতে হবে এবং ও যত্ন নিতে হবে। বাকিদের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
পাঁচটি মূল বিষয়
বাড়িতে বসে কোভিন–১৯–এ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৫টি মূল দিকে লক্ষ রাখাতে হবে। প্রথমত, আইসোলেশন রুম, দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, তৃতীয়ত, চিকিৎসা ও থেরাপি, চতুর্থত, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ, পঞ্চমত, পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা।
যে উদ্যোগগুলো নিতে হবে
১. আপনার বাসার একটা রুমকে কোভিড-১৯ সংক্রামিত রোগীর জন্য তৈরি করতে হবে একটি আইসোলেশন রুম।
২. আলাদা রুমের পাশাপাশি রোগীর জন্য সংযুক্ত বাথরুমের ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে ভালো।
৩. রুমটি থেকে বাড়তি ফার্নিচার সরিয়ে ফেলুন এবং রুমটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করুন।
৪. যে রুমটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যার অথবা আয়তনের জানালা আছে, সেটা রোগীর সেবার জন্য তৈরি করুন। খোলা জানালা, মুক্ত হাওয়া, সূর্যের আলো এবং জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য রোগীর শরীর ও মন দুটাই ভালো রাখবে।
৫. ঘরটিতে কার্পেট থাকলে তা সরিয়ে ফেলুন এবং পরিষ্কার করা কঠিন, এমন আসবাবসহ ডেকোরেশনের কিছু থাকলে তা বের করে ফেলুন।
৬. যদি রোগীর রুমে পরিবারের অন্য সুস্থ সদস্যকেও থাকতে হয় তবে রুমটিকে পর্দা দিয়ে আলাদা করে ফেলতে পারলে ভালো হয়।
৭. রোগীর বিছানার চারদিকে যথেষ্ট পরিমাণে জায়গা থাকা উচিত, কম পক্ষে ২ ফুট, যাতে করে দুজন মানুষ রোগীর যত্ন নিতে পারেন।
৮. রোগীর বিছানা যথাসম্ভব জানালার কাছাকাছি রাখুন, যাতে রোগী বিছানাতে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পারে।
৯. বিছানার পাশে একটা ছোট টেবিল রাখুন রোগীর জিনিসপত্র রাখার জন্য, যেটা খুব সহজেই পরিষ্কার করা যায়। রোগীর রুমের যেকোনো ফার্নিচারই যেন খুব সহজে পরিষ্কার করা যায়।
১০. রোগীর রুমে সব সময় বাতাসের প্রবাহ থাকা ভালো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বাতাস যেন ভেতর থেকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকেই যায়। বাতাস যেন রোগীর রুম থেকে অন্য রুমের দিকে না যায়।
১১. রোগীর রুমে ‘নেগেটিভ বাতাসের প্রবাহ’ তৈরি করা দরকার। এক্সজস্ট ফ্যান অথবা স্ট্যান্ড ফ্যান এই ক্ষেত্রেই কাজে দেবে। লক্ষ রাখতে হবে, বাতাসের প্রবাহ যাতে রোগীর রুম থেকেই জানালা দিয়ে বাইরের দিকেই যায়।
১২. ঘরে আর্দ্রতা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হলে সংক্রমণের আশঙ্কা কম হয়।
১৩. রোগীর বাথরুম থেকেই অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলুন, যাতে দরকার পড়লে দুজন মানুষ রোগীকে যত্ন নিতে পারেন।
১৪. সংক্রমণ রোধ ঠেকাতে রোগীর বাথরুম অন্য সুস্থ সদস্য ব্যবহার না করা উচিত।
১৫. রোগীর ময়লা বা নোংরা ফেলার জন্যই একটি অ্যালুমিনিয়াম এর তৈরি পাত্র রোগীর বিছানার কাছেই রাখুন। ঢাকনাসহ পাত্র হলে ভালো হয়।
১৬. রোগীর ময়লা বাড়ির অন্য ময়লা থেকে আলাদা রাখা ভালো। একটা পলিথিনের ব্যাগে করে রোগীর ময়লা ফেলুন, যাতে এখান থেকে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে। এই ময়লা বাড়ির বাইরে কোথাও পুড়িয়ে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভালো।
১৭. বাসায় থাকার সময় রোগীর মানসিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা উচিত।
১৮. বিভিন্ন ধরনের থেরাপি আছে, যা এই সময়ে কাজে লাগানো যায়, যেমন, আরোমা বা সুগন্ধি থেরাপি, অথবা সংগীত থেরাপি।
১৯. রোগীর রুমের দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্য আছে এমন সুন্দর ছবি থাকলে ভালো। এটা রোগীর স্ট্রেসের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে।
বাসার বাকি জায়গার প্রস্তুতি
১. পুরো বাসা আবর্জনামুক্ত করুন।
২. বাড়ির ভেতরে রোগীর থাকার জায়গা বা সংক্রামিত স্থান এবং এর বাইরে পরিষ্কার জায়গা চিহ্নিত করুন।
৩. রোগীর হাঁটাচলার জায়গা আবর্জনামুক্ত করুন এবং রোগীর ব্যবহারের পরপরই পরিষ্কার করুন।
৪. শিশুদের জন্য নির্ধারিত জায়গা ঠিক করুন। তাদের খেলার ব্যবস্থা এবং সৃজনশীল কাজের ব্যবস্থা করে দিন।
৫. পরিবারের সদস্যদের মানসিক সুস্থতার কথা বিবেচনায় রেখে প্রার্থনা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা উচিত।
৬. বাড়ির একটা বারান্দা ও অন্য কোনো স্থান সুন্দর করে গুছিয়ে তৈরি করে নিন, যেখানে পরিবারের কোনো সদস্য নিজের মতো কিছু সময় কাটাতে পারেন।
ওপরে তালিকাটিতে শুধু খুব দরকারি কিছু গাইডলাইন তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরেও আরও অনেক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই গাইড লাইন তৈরির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষ কোনো খরচ ছাড়াই সহজে বাসার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে পারে। এই গাইডলাইন অনুযায়ী বাসার আয়োজনটি নিশ্চিত করা গেলে একই সঙ্গে রোগীর সেবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সুস্থ রাখা সম্ভব হতে পারে।
ড. শারমিন কাদের: স্বাস্থ্য স্থাপত্য বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনা পরিষদের সদস্য