জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেরা জামিন না নিয়ে অনুসারীদের জামিনে বের করে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে র্যাব। তিন খুনের আসামি সাগর ও তার স্ত্রী ঈশিতাকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব মিডিয়া সেন্টারে মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কর্মকর্তারা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
গত শনিবার রাতে আশুলিয়ায় ফ্ল্যাট থেকে পোশাক শ্রমিক মোক্তারুল হোসেন বাবুল, স্ত্রী সাহিদা বেগম ও ছেলে মেহেদীর গলাকাটা লাশ পায় পুলিশ। এ ঘটনায় সোমবার রাতে সাগর ও তার স্ত্রী ঈশিতাকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারা জানায়, কবিরাজ সেজে নিহত মোক্তারের শারীরিক সমস্যার সমাধান করে দিতে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করে এই দম্পতি।
কিন্তু বাসায় ঢুকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে পুরো পরিবারকে অজ্ঞান করার পর, পুরো বাড়িতে পাঁচ হাজার টাকা পায়। এতে ক্ষেপে গিয়ে সাগর বটি দিয়ে পরিবারটির তিনজনকে খুন করে। তিন বছর আগেও ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের চার জনকে খুন করে সে জেলে ছিলো। কারাগারে এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারী হয় সে।
সেই সন্ত্রাসী নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করার দায়িত্ব দিয়ে জুনে সাগরকে জামিনে মুক্ত করে বলে জানায় র্যাব। দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, নিহত মোক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী সাহিদা বেগম আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাদের সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারের আশুলিয়া জামগড়া এলাকায় বহুতল ভবনের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভবনের অন্য ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়।
পরে ফ্ল্যাট থেকে মোক্তার, তার স্ত্রী সাহিদা ও তাদের ১২ বছরের শিশু ছেলে মেহেদীর অর্ধগলিত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রোববার (১ অক্টোবর) আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা হয়। তিনজনকে হত্যার এই ঘটনায় র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।
গত রাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা সাগর আলী ও তার স্ত্রী ঈশিতা বেগমকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডের সময় মোক্তারের কাছ থেকে লুট করা আংটি। গ্রেফতার সাগর টাঙ্গাইলের মোবারক আলীর ছেলে।
র্যাব জানায়, ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার সাগর সাভার বারইপাড়া এলাকার একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় ভিকটিম মোক্তার পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখেন। সাগর জানতে পারে মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো ফলাফল পায়নি।
সাগর কৌশলে ভিকটিম মোক্তারকে ডেকে নিয়ে আসে এবং ভিকটিমের সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারেন, ভিকটিম মোক্তারের ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ ও আস্থা রয়েছে। ভিকটিম মোক্তার তার ও তার পরিবারের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কথাও গ্রেফতারকৃত সাগরকে জানায়।
এ সময় গ্রেফতার সাগর জানায়, তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং সে তার সমস্যার সমাধান করে দেবে বলে আশ্বাস দেয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সাগর চিকিৎসার জন্য ভিকটিম মোক্তারের সঙ্গে ৯০ হাজার টাকা চুক্তি করে। সাগর ও তার স্ত্রী ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ওষুধসহ তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবে বলে জানায়। সাগরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোক্তার মোবাইল নাম্বার চাইলে তার আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর দেন।
বাসায় গিয়ে সাগর স্ত্রী ঈশিতাকে পুরো ঘটনা ও পরিকল্পনার কথা জানান। নগদ বিপুল অঙ্কের অর্থ পাওয়ার আশায় রাজি হন স্ত্রী তারা পরিকল্পনা করেন মোক্তারের বাসায় গিয়ে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে তার পরিবারের সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে এক বক্স ঘুমের ওষুধ ক্রয় করেন।
২৯ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রেপ্তার সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের সঙ্গে জামগড়া মোড়ে দেকা শেষে বাসায় যান। সেখানে প্রাথমিক পরিচয়ের পর গ্রেপ্তার সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শুনেন এবং ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে তাদেরকে খাওয়ান।
মোক্তার, তার স্ত্রী ও ছেলে ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তারের হাত ও পা বাঁধেন, পরে মোক্তারের স্ত্রীর হাত-পা বাঁধেন। পরে তারা মোক্তারের মানিব্যাগ, তার স্ত্রীর পার্স ও বাসার অন্য স্থানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য তল্লাশি করে মাত্র ৫০০০ টাকা পান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাসার বটি দিয়ে প্রথমে মোক্তারের গলায় উপর্যুপরি কোপ দিয়ে হত্যা করেন।
পরে অন্য কক্ষে গিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বটি দিয়ে পর্যায়ক্রমে কুপিয়ে হত্যা করেন। পালানোর আগে তারা মোক্তারের হাতে থাকা আংটি খুলে নিয়ে যান। গ্রেপ্তার দম্পতি ভিন্ন পথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি যায় এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে আত্মগোপনে থাকাকালেই গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে তাদের সোমবার (২ অক্টোবর) রাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার দম্পতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব মুখপাত্র।
তিনি বলেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেরা জামিন না নিয়ে কারাগার বা বিদেশে থেকে অপরাধ করলেও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরণের অনুসারী হিংস্র অপরাধীদের জামিনে বের করে আনছে। সম্প্রতি এসব জামিন পাওয়া অনুসারীদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে খুন বা তাদের উপরে হামলা করানো র্যাবের নজরে এসেছে বলেও জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।