অবৈধ অস্ত্র ও মাদক কেনাবেচা, বিদেশে অর্থ ও মানবপাচার, জঙ্গিদের অর্থায়ন এবং অনলাইন জুয়া— এই ছয় ধরনের অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রা। বিশেষ করে বিটকয়েনের মাধ্যমে এসব অপরাধ সংঘটিত হলেও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ অবস্থায় বিটকয়েনের ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনার পাশাপাশি বিটকয়েনের প্রযুক্তি সম্পর্কিত আধুনিক তথ্য ও জ্ঞান লাভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের সাইবার ইউনিট এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার সংগ্রহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে পুলিশ সদর দফতরে। পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক কাজী জিয়া উদ্দিনের সই করা সেই চিঠির আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির কারণে বিশ্বব্যাপী কাগুজে মুদ্রার পাশাপাশি ডিজিটাল মুদ্রার সূচনা ও ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশ্বের সর্বপ্রথম ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা হলো বিটকয়েন। ২০০৮ সাল থেকে চালুর পর থেকেই বাংলাদেশে অবৈধ এই মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়েছে। বৈধ পণ্য কেনাবেচা ছাড়াও বিটকয়েনের মাধ্যমে মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান, মানবপাচার, অর্থপাচারসহ নানা অবৈধ পণ্য ও সেবা কেনাবেচায় বিট কয়েন ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের শনাক্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দুরূহ হওয়ার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশে এর ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে মাদক, অর্থপাচার, অনলাইন ভিডিও গেমসের পেমেন্ট, অনলাইন জুয়া, মানবপাচার ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়নে বিটকয়েন বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারও হয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল মুদ্রার কোনও বৈধ অনুমতি নেই। আমরা নিয়মিত এ বিষয়ে নজরদারি করছি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, বিটকয়েনের মাধ্যমে অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি অর্থপাচারের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ, উচ্চমূল্য এবং পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ থাকায় অবৈধ সম্পদের মালিকরা এটি ব্যবহার করে সহজেই অর্থপাচার করতে পারেন। আমরা সব বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করছি।’
গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যেহেতু বিটকয়েনের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ ও এর ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করা যায় না, সেহেতু দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে এর ব্যবহার আগামীতে আরও বেশি বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বিটকয়েনে বিনিয়োগ করতে পারে। জঙ্গি সংগঠনগুলোও বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। বিটকয়েনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র কেনাবেচা আরও বেড়ে যাতে পারে বলেও ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের অনেক ফ্রিল্যান্সার তাদের কাজের পারিশ্রমিক বিটকয়েনের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। ব্যাংক ব্যবস্থায় বিটকয়েন অবৈধ হওয়ায় তারা বিভিন্ন বিটকয়েন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে।
গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বিটকয়েনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশও করা হয়েছে। এরমধ্যে বিটকয়েন ব্যবহার রোধকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ’র প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মনিটরিং জোরালো করতে হবে। পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার সংগ্রহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিটকয়েন ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশের প্রচলিত আইন, যথা- বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-সহ অন্যান্য আইনে বিটকয়েন প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত কঠোর ধারা যুক্ত করে আইনগুলো যুগোপযোগী করা যেতে পারে।