পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের অন্যতম অনলাইন কেসিনো এ্যাপের নাম স্টীমকার। বাংলাদেশে ভার্চুয়াল জগতে কোটি কোটি টাকা মানি-লন্ডারিং করার পাশাপাশি অভিনব পন্থায় সরকারকে ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে বিদেশি ভিত্তিক নিষিদ্ধ অ্যাপস স্ট্রীমকার নামক প্রতিষ্ঠান। স্টীমকার এ্যাপটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত একটি মাধ্যমের মত দেখালেও সত্যিকার অর্থে এটি অনলাইন কেসিনো বা জূয়ার জন্য পরিচিত একটি এ্যাপ। স্টীমকার নামক এই এ্যাপের ফাদে পড়ে যুব সমাজের একটি অংশ যেমন জুয়ায় তাদের অর্থ খোয়াচ্ছে। তেমনি মানি লন্ডারিংয়ের কারনে দেশ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা দেশের বাহিরে পাচার হচ্ছে। লোভে পড়ে জয়েন করার পর টাকা না পাওয়া ও হারানোয় অনেকে আবার আত্নহত্যাও করতে গেছেন।
সূত্রে জানা যায়, দেশে বেকারত্বে হাড় বাড়তে থাকলেও অনলাই জগতকে বর্তমানের তরুন এবং যুব সমাজ বাড়তি আয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে পছন্দ করে আসছে। কয়েক বছর ধরে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে অনেকেই ঘরে বসে বাড়তি আয় করছে লেখা পড়ার পাশাপাশি। আর সেই সুযোগ নিচ্ছে স্টীমকার নামক একটি এ্যাপ।
বিশেষ করে সুন্দরী তরুনীদের টাকা লোপাটের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করাই এই এ্যাপের অন্যতম একটি ফাদ। দিনে কমপক্ষে একঘন্টা ২০ মিনিট লাইভে থাকার কথা বলে সুন্দরীদের সাজিয়ে রাইভে রেখে উঠতি তরুনদের আকর্ষিত করেই টাকা আদায় করে স্টীমকার। এই একঘন্টা বিশ মিনিট এক মাস লাইভে থাকার পরে নির্ধারিত একটি বেতন দেবার কথা বলে সেটি দেয়না স্টীমকার কতৃপক্ষ। ফলে অনেকেই আত্মহত্যা করে স্টীমকারের ই লাইভে এসে। এমনকি চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই নিরীহ তরুন তরুনীদের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তাকে পুজি করে টাকা আয়ের জন্যও স্টীমকারের মত এ্যাপে এসে লাইভে যুক্ত হচ্ছেন।
জানাযায় দুবাই এবং ভারতে বসে কয়েকজন কেসিনো ব্যাবসায়ী স্টীমকার কেসিনো এ্যাপের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যার মধ্যে অন্যতম শুক্কুর আলী, যাকে স্টীমকার কেসিনোর হোস্টার রা কুল নামে চেনে। দুরন্ত নাম ব্যবহার করে অনলাইনে বাংলাদেশের তরুন তরুনীর কাছে বিনস্ বা কয়েন বিক্রি করে।যা বাংলাদেশ, দুবাই, এবং ভারতে থেকে নিয়ন্ত্রীত হয়। বাংলাদেশে লগআউট নামের একটি আইডি দিয়ে যা চট্টগ্রামের রোকন নামের এক ব্যাক্তি নিয়ন্ত্রন করে। মাসুদ আর খান যে গাজীপুর থেকে নিয়ন্ত্রন করেন এবং দেওয়ান নামের এক ব্যাক্তি বাংলাদেশে অন্যতম । তাছাড়া বাংলাদেশে বিডি ফেন্ড্র নামের একটি নাম দিয়ে ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে সর্বস্ব এক ব্যাক্তি এই স্টীমকার কেসিনো ব্যবসা পরিচাপলনা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, আউটসোর্সিয়ের মাধ্যমে এখন তো অনেকেই আয় করে। স্টিমকারের অফারের বিষঢটি আমাদের অনুপ্রানিত করে। যেহেতু বাসায় বসে থাকি সুতরাং এখানে একটু সেজে গুজে লাভিয়ে এসে কথা বলে যদি আয় আসে তাহলে কোন সমস্যা না দেখে আমরা শুরু করি।
তাদের নির্ধারিত প্রতিদিন ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট করে লাইভে আসি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা যে টাকা দেয়ার কথা বলছিল তা দেয়না। এভাবে একমাস, দুই মাস কিংবা তিনমাস করার পরও তারা টাকা দেয়না। এভাবে এক সময় আগ্রহ ফেললে দেখা যায় তাদের জমানো টাকা আর আসেনা। এই টাকা তারা হাতিয়ে নেয়।
ভুক্তভোগীরা আরো বলেন, লাইভে আসার পর তাদের টার্গেট থাকে মাসে ১০ লাখ কয়েন জমানোর। এক্ষেত্রে অনেকে ব্যর্থ হয় আবার অনেকে সফলও হয়। তবে সফল হোক আর ব্যর্থ হোক এখানে তারা যে অফার দেয় সেই অফারের প্রেক্ষিতে তারা টাকা দেয়না। ১০০ জনের মধ্যে ৫/৭ জন পায়। আর এদেরকে শো করে আরো তরুণ তরুণীকে টার্গেট করে।
জানা যায়, স্টীমকার মূলত আমেরিকা ভিত্তিক একটি কেসিনো এ্যাপ। যেটি নিয়ন্ত্রিত হয় একসাথে পাকিস্তান এবং ভারত থেকে। বাংলাদেশে অনুমোদন না থাকায় এই দেশে এ্যাপটি চলে ভিপিএন এ্যাপের মাধ্যমে। আর বাংলাদেশে এই কেসিনো এ্যাপটির নিয়ন্ত্রক কয়েকজন তরুন। যাদের মধ্যে অন্যতম লগ আউট, মাসুদ আর খান,এবং দেওয়ান এজেন্সি এবং স্বপ্ন এজেন্সি অন্যতম। যারা যাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
ব্যাংকের অনলাইন একাউন্ট, ডেভিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং অনলাইন ও মোবাইল মানি ট্রান্সফার এ্যাপের মাধ্যমে এই স্টীমকার টাকা আদায় করে পরে তা পাচার করে। যা মানি ল্ডারিংয়ের মত বড় অপরাধ। কিন্তু মোবাইল ভিত্তিক কার্যক্রম হবার কারনে এই এ্যাপটি এখনো ধরাছোয়ার বাইরে থেকেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে টাকা পাচার করছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ড. হোসেন মনসুর বলেন, বিভিন্ন নিষিদ্ধ অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা উদ্বেগজনক। আমরা দেখছি বিভিন্ন উপায়ে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে এই অ্যাপসও রয়েছে।
তিনি বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্ব বিটিআরসির। বিটিআরসি নজরদারী করে যেগুলোর অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করা। তিনি বলেন, এটি যেহেতু নিষিদ্ধ অন্য উপায়েও পরিচালিত হয় সেহেতু এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, অনলাইন কিংবা মোবাইল অ্যাপস কেন্দ্রীক যে কোন অপরাধ নিয়ন্ত্রনে সিআইডি, সাইবার পুলিশ এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এ বিষয় আমরা নজরদারী বাড়াচ্ছি। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ে আমরা বসে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করবো। তিনি জানান এরই মধ্যে কয়েকজনের নাম, ছবি, মোবাইল নাম্বার এবং বেশ কয়েকটি একাউন্ট নাম্বার পেয়েছে তারা। সেসব যাচাই বাছাই করে পরবর্তীতে এই কেসিনো এ্যাপ স্টীমকারের সাথে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারী অভিযান পরিচালনাসহ আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
তিনি আরো বলেন, এই কাজটি কারা, কিভাবে করছে এটি জানার জন্য আমাদের নজরদারী করতে হবে তারপর আমরা অ্যাকশনে যেতে পারবো।
স্টীমকার এ্যাপের বাংলাদেশে কোনো বৈধ অফিস না থাকায় তাদের বক্তব্যে নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে তরুন তরুনীদের ভবিষতের কথা মাথায় রেখে এবং মানি লন্ডারিং রোধে অবলিম্বে এই এ্যাপ বন্ধের তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, অনেক অ্যাপস আছে যেগুলোর মাধ্যমে টাকা ইনকাম করা যায়। আবার অনেক অ্যাপস আছে যেগুলো জুয়ায় ব্যবহৃত হয়। স্ট্রীমকার তেমনি একটি অ্যাপস যাতে জুয়া খেলে। এই অ্যাপসটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু ভিপিএন কানেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশি কিছু যুবক এটি নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
এই অ্যাপটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এই গ্রুপকে ধরতে আমরা কাজ করতেছি।
তিনি আরও বলেন, সর্বোপরি সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। অনলাইনে আয় করবেন না খরচ করবেন সেটি নিজের উপরই নির্ভর করে। লোভে পড়ে কোন কিছু করতে গেলে সেই দ্বায়দ্বায়িত্ব নিজের উপরই বর্তায়।