ইসলামী আলোচক ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের হোমকোয়ারেন্টিন করতে চায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও সরাইল থেকেই বেশিরভাগ মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন ধারণা করে এই দুই উপজেলায় পুলিশ পাঠানো হচ্ছে। পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান এই তথ্য জানান। এরইমধ্যে সরাইলে ছয়টি গ্রাম লকডাউন করা হয়েছে। গ্রামের কেউ যাতে বের হতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হচ্ছে।
শনিবার (১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জেলার আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন বেশি অংশ নিয়েছে ওই জানাজায়। ওইসব গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। যেন ওই গ্রামগুলোর লোকজন ঘর থেকে না বের হতে পারেন সেজন্য তাদের হোমকোয়ারেন্টিন করা হবে।’ তিনি জানান, ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ছোট পরিসরে জানাজা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আমাদের কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তারা করেননি।’
সরাইলের পানিশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিন ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘মাওলানা জোবায়ের আনসারীর মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) কোনও মাইকিং হয়নি। আমরা শুনিনি। মানুষ কীভাবে দলে দলে অংশ নিতে গেলো সেটা বলতে পারবো না। ফেসবুক থেকে জেনে হতে পারে। তবে আজ শনিবার বিকাল ৫টার পর এই উপজেলার ছয়টি গ্রাম লকডাউন করা হয়েছে। বেড়তলা, বলিবাড়ী, সীতাহরণ, শান্তিনগর, মইশার, টিঘর এই গ্রামগুলো লকডাউন হয়েছে।’
সরাইল থানার ওসি শাহাদাত হোসেন টিটু জানান, ‘জেলা লোকডাউনের পরও আলাদা করে এই ছয়টি গ্রাম লকডাউন করা হলো। এখান থেকেই বেশি লোক জানাজায় অংশ নিয়েছে। যেহেতু লোকজন লকডাউন উপেক্ষা করে বের হয়েছে এবং হচ্ছে, তাই এলাকা বিশেষভাবে লকডাউন করা হলো। এখানে কারও কিছু প্রয়োজন হলে বা জিনিসপত্র কিনতে হলে তারা পুলিশকে জানাবে। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’
গত শনিবার (১১ এপ্রিল) সন্ধ্যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় লকডাউন চলছে।
’তেমন একটা সমস্যা হবে না’
জেলা খেলাফত মজলিস শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মঈনুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ‘লাখো জনতার ঢল ঠেকাতে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। চেয়েছিলাম জানাজায় যেন লোক সমাগম কম হয়। কিন্তু উনার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এতোটাই ছিল, যার কারণে হাজার-হাজার লোকের সমাগম হয়ে যায়।‘
তিনি বলেন, ‘অধিক লোকের কারণে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির কথা আমরা বুঝি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন একটা সমস্যা হবে না। কারণ যারা ঝুঁকিতে আছেন তাদের তো প্রশাসন ঘরেই রেখেছেন। যার কারণে লোক সমাগম একটু বেশি হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মঈনুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিশ্বখ্যাত ইসলামী আলোচক মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী দীর্ঘ চার বছর ধরে দূরারোগ্যে ক্যান্সারে ভুগছিলেন।’
মাওলানা জোবায়ের শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মার্কাসপাড়ায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে আজ শনিবার সকাল ১০টায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা শেষে সরাইল উপজেলার বেড়তলায় অবস্থিত জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তাকে দাফন করা হয়।
জানাজায় অংশ নেওয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মো. মোবরক উল্লাহ বলেন, ‘রাসুল (সা.) প্রায় ১৪ শ’ বছর আগেই বলে গেছেন, যেখানে মহামারি সেখানে না যেতে, ঘর থেকে বের না হতে। যে কারণে ওই জানাজার জন্য আমরা মাইকিং করিনি লোকজন বেশি হবে বলে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনে শ্রদ্ধায় অনেক লোক চলে আসে।’
সচেতন মহলের প্রতিক্রিয়া
মাওলানা জোবায়ের আনসারীর জানাজায় লকডাউন ভেঙে লাখো মানুষের সমাগমে জেলায় বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিবেককে কবর দিয়ে আবগকে প্রাধান্য দিয়ে যে কাজ করি, এটাই তার প্রমাণ। কারণ ধর্মীয় আদেশ ও সরকারি আদেশে লোক সমাগম নিষেধ করা হয়েছে। এরপরও এতো লোক সমাগম কেন?’ তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এতো লোক কি আকাশ দিয়ে এসে জমায়েত হয়েছে। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে। এখন আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। তারা (আইন শৃঙ্খলা বাহিনী) কোথায় ছিলেন। এটা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো ব্যর্থতা ও এ দায় তাদের।’
জেলা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, ‘বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে দুই জনের বেশি লোকসমাগম নিষিদ্ধ। সেখানে হাজারও বা লাখো লোকসমাগম হওয়াটা জনস্বার্থের পরিপন্থী। ঘটনাটি বিব্রতকর ও বেদনাদায়ক।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন, ‘উনারা (মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ) আমাদের বলেছিলেন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করবেন। কিন্তু সেটা তারা কেন করেননি তা খতিয়ে দেখা হবে।‘
আরও পড়ুন-