ঘুম ভাঙছে পাখির কলতানে। দিনভর কিচিরমিচির। আকাশভরা তারা। ধূলো উড়িয়ে বিকট আওয়াজ নেই। ধোঁয়া নেই। সন্ধে নামলেই মিরপুর ডিওএইচএস এর বাসার বারান্দায় বসে শুনতে পাই শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। এ যেন অপার্থিব কোনেও দৃশ্য, যা ইদানিং খুব অচেনা, একটা স্বপ্ন, তবে স্বপ্নটা শুভ নাকি অশুভ জানিনা। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয় বিশ্বজুড়ে দানবেরমত এক থাবায় সবাইকে বোকা বানানো করোনা অনেকটাই আমাদের জন্য শুভ। কারন করোনা আমাদের অনেক কিছু শেখাচ্ছে। আমাদের অনেক কিছু নতুন করে চিন্তা করতে সুযোগ করে দিচ্ছে। ঘর, বাড়ি, আংগিনা, আকাশ,বাতাস, গাছ, পালা, সাগর, রাস্তা, ঘাট সবকিছু নির্মল পরিসুদ্ধ পরিচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। পরিবারের সাথে মিলে মিশে সময় কাটানো, একজন আর একজনের খোঁজ খবর নেয়া, ভালোবাসার গভীরতায় নতুন করে শেখাচ্ছে।
করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিনিয়ত মানুষের নতুন নতুন নাম যুক্ত হলেও প্রকৃতি ফিরছে আপন রূপে। পৃথিবীর সব মানুষ আতঙ্কে থাকলেও শুধু প্রকৃতিই যেন হাসছে। করোনায় লকডাউনে বাতাসে দূষণ কমতে থাকায় ভারতের পাঞ্জাব শহর থেকে কয়েক দশক পর সরাসরি হিমালয় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের এ প্রদেশটির প্রায় ১০০ মাইল দূরে থেকে পর্বত মালা দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ খালি চোখে। তাবৎ বিজ্ঞানীরা যা করতে পারলেন না, তা করে দেখাল মরণ ভাইরাস করোনা। ভাইরাস সংক্রমণের ভয় মানুষকে গৃহবন্দি করেছে। লকডাউন জারি হয়েছে দেশজুড়ে। বন্ধ হয়েছে রাস্তায় গাড়ির ঢল। স্তব্ধ হয়েছে কারখানার সাইরেন। আগামীর অর্থব্যবস্থা কোথায় ঠেকবে কেউ জানেন না। তবে লকডাউনের আবহে দূষিত রাজধানীর মানুষ যেন অক্সিজেন ফিরে পেয়েছেন।
অথচ!! আমাদের দেশে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে, যাদের আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো কার্যক্রম দেখিনি। কোনোদিন কোনো মাধ্যমেও কোরোনার এই ক্রান্তিকালে কোনো কার্যক্রম এখনো শুনিনি। এক সকালে একজন শিল্পপতির ইন্টারভিউ একটি বেসরকারি চ্যানেলে লাইভ দেখছিলাম। উনি কোরোনা আক্রান্ত একজন সাহসী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তার অভিজ্ঞতাটা সাত সকালে আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। আমি মন দিয়ে উনার পুরো লাইভ প্রোগ্রামটা দেখেছি এবং ভেবেছি যারা বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের কি অবস্থা আর আমরাও তো যেকোনো সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারি।
গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে তালিকাভুক্ত ছিল। তাছাড়া ঢাকার বরাবর বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের শীর্ষে ছিল। তবে দেশটিতে চলমান লকডাউনের ফলে রাজধানীর বাতাসে দূষনের পরিমাণ ৪৪% কমেছে বলে জানতে পারি। সেই ব্যবসায়ী ঢাকায় তার নিজের বাসায় তিন চার দিন জ্বরে আক্রান্ত থাকার পর কোরোনার লক্ষণ থাকায় ১৪ তারিখে করোনা টেস্ট করান এবং ১৫ তারিখে তার করোনা টেস্ট রেজাল্ট পসিটিভ আসে। তার করোনা পরীক্ষা করানোর অভিজ্ঞতাটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমরা শুনেছি করোনা আক্রান্ত মানুষেরা প্রচন্ড মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রনায় ভোগেন।
এই বৈশাখের খড় তাপে, প্রচন্ড গরমে, তিন চার ঘন্টা অসুস্থ অবস্থায় লাইন এ দাঁড়িয়ে টেস্ট করানোর গন্তব্যে পৌঁছানোটা সত্যি অসম্ভব ছিল। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ, মানুষের লম্বা লাইন । ওখানে অনেকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাটিতে বসে যাচ্ছিলেন। এমন দুর্গন্ধময় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
উনি বলছিলেন এমন পরিবেশে কেউ বেশিক্ষন থাকলে অসুস্থ ফীল করার কথা। আচ্ছা এমন কি হতে পারে না?
ডেকোরেটাৰ থেকে ২০০ চেয়ার একটি শামিয়ানা? সারাদিন কেন যেন খুব চিন্তা হচ্ছিলো।
এখন তো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম,আরো যদি বাড়ে? এই লাইনটা তখন কত লম্বা হবে এবং কে জানে কতক্ষনে পরীক্ষা, করানো হবে? বা বর্ষাকালে? তখনই বা কি হবে? না আর ভাবতে পারছি না।
এমনিতেই একটি অজানা শংকায় মনটা খুব দুর্বল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এভাবে দুমাস ধরে বাসায় বসে আছি, সামাজিক দূরত্ব মেনে লোকডাউনের সময়টা পার করছি। বহুদিন স্বপ্নও দেখিনা। প্রজাপতি, ফুল, পাখি, খোলা আকাশ প্রাণ খুলে বাতাসের সেই চির সবুজ ঘ্রান নেয়ার কথাটা ভুলেই যাচ্ছি চার দেয়ালের মাঝে। হটাৎ অসম্ভব একটি দুঃস্বপ্নে আজ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙেই গেল।
অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। আমি ভাবছিলাম কি দেখলাম স্বপ্নে! স্বপ্নটা এমন কেন ছিল? মনের অজান্তেই একজনকে কিছু প্রশ্ন করছিলাম। আমি জীবনে কোনো টকশোতে এটেন্ড করেছি বলে মনে পরে না – কিন্তু!
তবুও একজনকে প্রচন্ড ভাবে কলার চেপে ধরে জানতে চাচ্ছিলাম আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রী কে! আমাদের দেশের সব জায়গা এত অপরিচ্ছন্ন কেন! কেন পাবলিক টয়লেট, বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন গুলো এত্তো অপরিষ্কার, এত্তো অপরিচ্ছন্ন? তাদের কোনো দায়িত্ব নেই?
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। কেন হজ ক্যাম্প গুলো এত অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার? কেন করোনা নমুনা কলেকশনের পরিসর পরিবেশ বান্ধব নয়? কেন এত অপরিচ্ছন্ন? কেন ঢাকা – মাওয়া রোডে হাজার-হাজার গাছ কেটে উধাও? এগুলো কোথায়? উনি শুধুই নিশ্চুপ।
ঘুম থেকে উঠে আমি কাঁপছিলাম। পরে বুঝলাম আমি আমার রুমেই আছি। আমার সামনে কেউ নেই।করোনা আমাদের অনেককিছু শেখাচ্ছে! ভাবতে! বুঝতে! বলতে!
ঘরে থাকুন ভালো থাকুন।
লেখক: শাহরীন জে হক,