জামিন নামঞ্জুরের আদেশের পর ঘটনাপ্রবাহে চার ঘণ্টার মধ্যেই পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজকে তাঁর কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নতুন বিচারকের ‘জামিন মঞ্জুর’ করার ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হচ্ছে বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

নিকট অতীতে জঘন্য ও নৃশংস কিছু হত্যা বা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বীভৎসতা সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে প্রচারিত হতে দুই-চার-পাঁচ-দশ দিন লেগেছে। এসব ঘটনার তোলপাড় হওয়া প্রতিক্রিয়া তাই গড়ে উঠেছে আস্তে আস্তে কয়েক দিন ধরে। আর পিরোজপুরের ঘটনা পুরোটাই ঘটেছে কয়েক ঘণ্টায় এবং জানা গেছে তাৎক্ষণিকভাবে। জামিন না দেওয়া, স্বাস্থ্যগত কারণে বিশেষ ব্যবস্থার আদেশ দেওয়া, তৎপরবর্তী সময়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই জামিন দেওয়া এবং এসব ঘটনাপ্রবাহের মাঝখানে জেলা ও দায়রা জজের ওএসডি হওয়ার আদেশ—সবকিছুই ঘটেছে অল্প সময়ের মধ্যে এবং দেশবাসীও ঘটনাটি বুঝেছে ততটাই অল্প সময়ে। অবশ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কিছু ‘ফলোআপ স্টোরি’, অভিযোগ ও পাল্টা–অভিযোগের পালা শুরু হয়ে গেছে।

বর্তমান আইনমন্ত্রী স্বভাবসুলভভাবেই গোঁজামিলের একটা বক্তব্য দিয়েছেন। পূর্বতন বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের ঘটনার নজির তাঁর স্মরণাতীত।

২.
আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিশৃঙ্খলা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জামিন ‘না দেওয়া’ জেলা ও দায়রা জজকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা প্রয়োজন ছিল। অতএব এখান থেকে সব বিচারকের জন্য আইনের যে নতুন শিক্ষা ও দীক্ষা নিতে হবে, সেটা হলো আপনারা এমন কোনো রায় বা আদেশ দেবেন না, যাতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে অথবা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে, সে রকম পরিস্থিতি আপনাদের রায় বা আদেশের কারণে উদ্ভব হলে আপনাদের কপালে জুটবে তাৎক্ষণিকভাবে ওএসডির তকমা। যে বিচারকেরা আপনাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তাঁদের করণীয় হবে বিশৃঙ্খলা বা পরিস্থিতি ঘোলাটে করা আদেশ উল্টে দেওয়া। এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিবর্তে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে বিচারকদের কাজ। অন্যদিকে, প্রচুর জনসমাগম হয়, ক্ষেত্রবিশেষে এ রকম অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি না দেওয়া এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেগুলোর জন্য তিন-চার-পাঁচ থেকে এক ডজন স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনীর ব্যবস্থা করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখন থেকে প্রধান করণীয়। আর বন্দুকযুদ্ধ খেলা, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি দায়িত্বও বহাল থাকবে।

সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীন। ছবি: সংগৃহীত

৩.
বহুদিন ধরেই ভাঙা রেকর্ড বাজছে, গানটার প্রধান পঙ্ক্তি হলো ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ’। এই প্রথম পঙ্ক্তি পেরুনো যাচ্ছে না প্রায় এক কুড়ি বছর ধরে। ১৯৯৯–এর মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর কত সরকার এল–গেল, কিন্তু কিছুই হলো না। বিচার বিভাগ স্বাধীন ও পৃথক না হওয়ার কত যে খেসারত দিচ্ছে বিএনপির নেতারা, তার সম্পূর্ণ ফিরিস্তি অসম্ভব। তবে এককথায় বলা যায় যে, অর্ধশতাধিক মামলা খায়নি এমন কোনো ব্যক্তি বিএনপির নেতৃত্ব পর্যায়ে নেই। সরকার বদল হলে আওয়ামী লীগের নেতাদের কপালে সেঞ্চুরি তো জুটবেই, কিছু কিছু বিশিষ্ট নেতা ডাবল সেঞ্চুরিও খেতে পারেন। স্পষ্টতই বিচারপতিরাও বাদ পড়বেন না, যেহেতু একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও মামলা খাওয়ার তালিকায় ইতিমধ্যে শামিল হয়ে গেছেন। অবশ্য ভীষণ ধরনের বোকা লোকেরা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না অথবা দিনে–রাতে ২৪ ঘণ্টাই থাকে দিবাস্বপ্নে বিভোর।

৪.
দেশের একটা বিরাট ও ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেল। এই ক্ষতিটা কিছু বোমা ও জঙ্গি হামলার ঘটনা থেকেও গভীরতর ক্ষত সৃষ্টি করবে। কিছু অপরাধীকে তাৎক্ষণিকভাবে মেরে অথবা বিচার করে শাস্তি দিয়ে এই ক্ষত সারানো যাবে না। অনেকে অবশ্য ভাবছেন যে একজন বিচারককে ওএসডি করে এবং সরকারি দলের একজোড়া নেতা–নেত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে সুব্যবস্থা করে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল। মহাভারত যে অশুদ্ধ হয়েছে, সেটা যদি বোঝার ক্ষমতাই থাকত, তাহলে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হতো না।

এক অর্থে ঘটনাটা ছোট, ঘটেছে মফস্বলে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা আধা ডজনেরও কম, সময়ও লাগেনি আধা ডজন সংখ্যার বেশি। কিন্তু এটা সহজেই অনুমেয় যে, বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থায় যে ঢল নামবে বা গত কয়েক ঘণ্টায় নেমেই গেছে, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ না নিলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ঠেকানো যাবে না। কেউ কোথাও, বলতে গেলে কোনো কিছুই মানছে না—ট্রাফিক আইন, মাদক, সিন্ডিকেট, ব্যাংক লুট, ক্যাসিনো, পাপিয়া, উপাচার্যসহ বেশির ভাগ কর্মকর্তার নিয়োগ–বাণিজ্য, হাজার হাজার টাকার বালিশ—এই ফিরিস্তি যে কেউ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারবে। ইদানীং অবশ্য বাচ্চাদের চকলেট, টফি, লেবেঞ্চুস খাওয়ানোর মতো আমাদের মাঝেমধ্যে বলা হয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই চোর আর ওই ডাকাতকে ধরা হচ্ছে, অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। অর্থাৎ এ দেশের জনগণ শিশুতোষ সাহিত্যে মশগুল।

৫.
আইন মন্ত্রণালয়ের থাবার হাতটা কেটে দিয়ে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এইটা গণতন্ত্রের অবশ্যপালনীয় দ্বিতীয় শর্ত। সরকারের আইন মন্ত্রণালয় দরকার। সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো আইনের খসড়া তৈরি করা; সরকারি আইন কর্মকর্তাদের (অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, পিপি, জিপি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আইন কর্মকর্তা ইত্যাদি) কাজের তদারকি করা; বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে আইনি পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। আর বিচার বিভাগ পরিচালনা করবেন সুপ্রিম কোর্ট। এতে আইন মন্ত্রণালয়ের নাক গলানোর কোনো ধরনের এখতিয়ার থাকবে না। বিচারকদের যদি বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং ওএসডি হওয়ার ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়কে খুশি করে চলতে হয়, তাহলে তাঁরা বিচার করতে পারবেন না। আর যে সমাজে সুষ্ঠু বিচার হয় না, সেই সমাজ টেকে না। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার যতগুলো দেশে আজকের চরম সহিংসতা, নৈরাজ্য, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি, হানাহানি, মারামারি চলছে, সেসব দেশে দুটি ফ্যাক্টরই কমন—সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না আর বিচার বিভাগ চলে সরকারের আঙুলের ইশারায়।
যা কিছু চেষ্টাচরিত্র, আশা–ভরসা ছিল, এক ওএসডির ভূমিকম্পে সেই সবকিছুই আজ প্রায় নিবে গেছে। দেশটাকে প্লিজ এত নিচে নামাবেন না।

তবে আমরা কখনো আশা ছাড়ি না, আশা ছাড়লে এ দেশের জনগণ পাকিস্তানি আর্মিকে হারাতে পারত না। তাই এ মুহূর্তে পরিস্থিতি যত অসহনীয় মনে হোক না কেন, খুব দ্রুতই এটাকে বদলে দেওয়া সম্ভব। স্বাধীন ও পৃথক বিচার বিভাগ হবে মুজিব বর্ষে দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় ও প্রয়োজনীয় উপহার এবং এটা মাত্র দুই মাসেই করা সম্ভব।

ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; আইনের শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।

Leave a Response