ভবিষ্যতের যুদ্ধে মানুষের জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত চলে যেতে পারে যন্ত্রের হাতে৷ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে৷ এই প্রেক্ষাপটে এসব অস্ত্র তৈরিতে নিষেধাজ্ঞায় দেশগুলোকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে জাতিসংঘ৷
স্বচালিত অস্ত্রকে কীভাবে মানুষ হত্যায় কাজে লাগানো হতে পারে, তা তুলে ধরা হয়েছে ‘স্লটারবোট’ শিরোনামের একটি ফিকশনাল ফিল্মে৷ এর একটি ক্লিপ ইউটিউবে শেয়ার করেছেন এ ধরনের অস্ত্রের বিরোধিতাকারীরা৷ এতে দেখা যায়, একটি লেকচার হলে খুব ছোট ছোট ড্রোন ভো ভো করে ঘুরছে এবং সেখানে থাকা শিক্ষার্থীদের মাথায় গুলি করছে৷ অতি ক্ষুদ্র এসব ড্রোন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ‘টার্গেট’ শনাক্ত করে৷ একবার কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হলে সে আর পালাতে পারে না৷ ড্রোনগুলো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তথ্য বিনিময় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে৷ এই ফিকশনে শুধু নির্দিষ্ট একটি ভিডিও শেয়ার করা ব্যক্তিদেরই হত্যা করে তারা৷
২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউটিউবে পোস্ট করার পর ২৫ লাখ বার এটি দেখা হয়েছে৷ তাই একে কেবল বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী হিসেবে মানতে নারাজ স্বচালিত বা স্বয়ক্রিয় অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে প্রচার চালানো টমাস কুচেনমাইস্টার৷ তাঁর মতে, এটা বাস্তবে হওয়া থেকে মাত্র ‘এক ধাপ দূরে’৷
জার্মান সংস্থা ‘ফেসিং ফাইন্যান্স’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুচেনমাইস্টার৷ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত ‘স্টপ কিলার রোবটস’ ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছে সংস্থাটি৷ নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখতে প্রায়ই উইপনস মেলায় যান কুচেনমাইস্টার, সেখানে প্রস্তুতকারীদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি৷
একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র এরইমধ্যে চলে এসেছে৷ যেমন, স্বাধীনভাবে সম্ভাব্য টার্গেট শনাক্তকারী রকেট তৈরি হয়েছে৷ কাকে বা কী ধ্বংস করতে হবে, সে সিদ্ধান্তও তারা নিজেরাই নিয়ে থাকে৷ সেগুলো এখনো দৃশ্যত মানুষের হাতে পরিচালিত হলেও গুলিবর্ষণের আদেশ কোনো সৈনিক দিতে পারেন না৷ এমনকি কেউ সেটাকে আটকাতেও পারে না৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসে অগ্রগতির হাত ধরে ধারাবাহিকভাবে স্বচালিত অস্ত্র ব্যবস্থারেও উন্নয়ন ঘটছে৷ এখন শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে-মানব মস্তিষ্কের মতো সেগুলো কৃত্রিম স্নায়ুবিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করে৷ একে কাজে লাগানো হচ্ছে অস্ত্র শিল্পে৷ আরও দ্রুত গতির ও কাযর্কর অস্ত্র তৈরি হচ্ছে৷ সেগুলো ব্যবহারকারী সৈনিকদের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিও কমিয়ে আনা হচ্ছে৷ আর এটাই সেনাবাহিনী চায়৷
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে অস্ত্রের উন্নয়ন কোনো নির্দিষ্ট সীমায় বেঁধে না রাখাতেই বিপত্তি৷ স্বাধীনভাবে মাইন খুঁজে তা নিস্ক্রিয়কারী রোবোটকে সবাই স্বাগত জানাবে৷ কিন্তু নিজের মতো করে ‘টার্গেট’ ঠিক এবং শনাক্ত করে মানুষ হত্যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থি৷
‘বিশ্ব শাসন করবে’
সামরিক কর্মকাণ্ডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে বিপুল অর্থ বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো স্বচালিত অস্ত্রের ওপর নিষধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করছে৷ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে একদল স্কুলশিশুর প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের বার্তায় এ বিষয়ে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট হয়৷ তিনি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নেতৃত্বদাতারাই বিশ্ব শাসন করবে৷ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনই ভবিষ্যতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি৷
যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন ব্যাপকভাবে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে৷ এসব অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ নিয়ে গত এপ্রিলে জেনেভায় সমঝোতা আলোচনায় স্বচালিত অস্ত্রকে একটি ‘ভালো বিষয়’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে তারা৷ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করেন, যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিক হত্যা এবং নিজেদের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব অস্ত্র সহায়তা করে৷
এর পক্ষে আরো যুক্তি দিয়ে তাঁরা বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্যের ভারে একজন সৈনিক বিভ্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু কম্পিউটার সেগুলো সহজভাবে নিতে পারে এবং তুলনামূলক কম ভুল করে৷
স্বচালিত অস্ত্রের বিকাশ বন্ধের কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা৷ এখন পর্যন্ত ২৬টি দেশ স্বচালিত অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে৷ তাদের এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়েছে সিভিল সোসাইটি৷ স্বচালিত অস্ত্রের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকান ফিউচার অব লাইফ ইনস্টিটিউটের তৈরি করা একটি পিটিশনে ২৩০টির বেশি সংস্থা এবং তিন হাজারের বেশি ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন৷ তাদের মধ্যে টেসলা বস এলন মাস্ক এবং গুগলের দ্বীপ মাইন্ডের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তা ও গবেষকরা রয়েছেন৷
স্বাক্ষরদাতারা প্রাণঘাতী স্বচালিত অস্ত্রের বিকাশে সহায়তা করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ পাশাপাশি এসব অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ‘কঠোর আন্তর্জাতিক আইনের আহ্বান জানিয়েছেন৷