চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা। এই ব্যয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সরকারকে আয় করতে হয়। আয়ে না কুলালে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় সরকার। এর বাইরে বিদেশি সংস্থা থেকেও ঋণ নেওয়া হয়। এ বছর অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা ধরনের চাপ আছে।
এ অবস্থায় সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন সরকারি দলিলেও স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু কেন জানি সরকার এই খাতের সংস্কারে আগ্রহী হয় না। হয়তো এই ধরনের সংস্কার যেন না হয়, সে জন্য একটি বড় কায়েমি গোষ্ঠী পেছন থেকে কাজ করে। আমরা সবাই রাজস্ব খাতের দুর্বলতা জানি। রোগটা কী, কী ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু আমরা ওষুধ খাই না।’ তিনি আরও বলেন, বাজেটের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের জোগান দিতে রাজস্ব খাতের সংস্কারের বিকল্প নেই।
সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে শুল্ক-কর আদায়। চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেওয়ার কথা এনবিআরের। এ জন্য সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়।
কিন্তু করোনার কারণে এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি। অর্থনীতিতে চাঙাভাব নেই। ফলে শুল্ক-কর আদায়েও তেমন গতি নেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুন-মার্চ) মাত্র ২ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। গতবারের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, পুরো অর্থ জোগান দিতে এনবিআরকে অর্থবছরের শেষ তিন মাসে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা না থাকার কিছু ইঙ্গিত অবশ্য মেলে রাজস্ব আদায়ে। যেমন ভ্যাট আদায়। জুলাই-মার্চ সময়ে ভ্যাট বিভাগ আয় করেছে ৭৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে আয়কর আদায় হয়েছে ৬৩ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আট হাজার কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ বেশি। এ দুটি খাতে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাকি তিন মাসে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দরকার।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার সুফল পাচ্ছে শুল্ক বিভাগ। কারণ, আমদানি মূল্যের ওপর শুল্ক নির্ধারণ হয়। আমদানি মূল্য বাড়লে তখন আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায়ও বাড়ে। ৯ মাসে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে ৬৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেশি। গত এক দশকে এমনটা দেখা যায়নি।
এনবিআর ছাড়াও কিছু খাত থেকে কর এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় হয়। সেখানেও এবারে ভালো খবর নেই। এনবিআরবহির্ভূত করের মধ্যে আছে মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, স্ট্যাম্প রাজস্ব ইত্যাদি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে এনবিআরবহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্য ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে আদায় হয়েছে ২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের মাত্র ১৮ শতাংশ। এমনকি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ কোটি টাকা কম। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাভ-মুনাফা, সুদ, ভাড়া, ইজারা, টোল, জরিমানা, সেবা বাবদ প্রাপ্ত মাশুল ইত্যাদিও করবহির্ভূত রাজস্ব। এ খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আদায় মাত্র ১৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা গতবারের একই সময়ের চেয়ে ৯ হাজার কোটি টাকা কম।
বাজেটের খরচের খাতের সরকারি কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি—এগুলো অনেক অবধারিত খরচ। এগুলো কমানোর সুযোগ কম। বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় এসব খাতে। এর বাইরে এডিপির মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে, চলতি অর্থবছরেই গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। এ বছর সংশোধিত এডিপির আকার ২ লাখ ১৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ মাসে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ খরচ হয়েছে।
এ নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখন নানা চাপে আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্য ঘাটতি, ডলার সংকট নিয়ে এক দশকে অর্থনীতি এত চাপে পড়েনি। এখন সরকারি খরচে কৃচ্ছ্রসাধনের সময়। বাজেটের আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আমদানিনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুটা শ্লথ করা যেতে পারে। বড় প্রকল্পেও বরাদ্দ কমিয়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে। অর্থনীতি চাপে থাকলে সামাজিক খাতে আঘাত আসে। তাই সামাজিক নিরাপত্তায় যেন বরাদ্দ না কমে।